মোশাররফ মুন্না।
মালিক তুমি জান্নাতে,তোমার কাছে আমায়,একটি ঘর বানিয়ে দিও…
এমন শতশত বিখ্যাত ইসলামী সংগীতের সুরকার ও শিল্পী সুর সম্রাট মশিউর রহমান। তিনি ছোটবেলা থেকেই গান গাওয়ার চেষ্ঠা করতেন। মূলত তার বাবা মায়ের উৎসাহে ইসলামি সংগীত অঙ্গনে তার পথচলা শুরু হয়। তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি থেকেই সংগীতের নানা প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়িয়ে তিননি অংশগ্রহণ শুরু করেন উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগতিামূলক অনুষ্ঠানে। তৃতীয় শ্রেণিতে থাকা কালেই একটি প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রথম পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের গানের সংকলন “নজরুল ইসলাম:ইসলামি গান” ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত চমৎকার এই বইটি। স্কুল জীবনের প্রথম পুরস্কারের মলাটে থাকা জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের ঝাঁকড়া চুলের নান্দনিক ছবিটি শিল্পী মশিউর রহমান এর হৃদয়ে দাগ কাটে। পুরস্কার পাওয়া বইটিতে থাকা ২৫০ টিরও অধিক নজরুল সংগীত তাকে গানের ভুবনে ভীষণ অনুপ্রেরণা যোগায়। শিল্পী জীবনের প্রথম যে গান গেয়ে পুরস্কার পেয়েছিলেন তা হলো কবি মতিউর রহমান মল্লিক এর “নেই কেহ নেই আল্লাহ ছাড়া/ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”এই গানটি।
৫ম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বাবার মাধ্যমে ফুলকুড়ি পত্রিকার সাথে পরিচয় হয়।সেই পত্রিকার মাধ্যমে তার সুস্থ ধারার কার্টুন, গল্প, কবিতা ও গানের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়। পাশাপাশি তার বাবা তাকে ফরিদপুরের একটি গানের আসরেও ভর্তি করিয়েছিলেন।
সংগীতের প্রতি সন্তানের এমন দরদ ও সাফল্য দেখে শিল্পী মশিউর রহমান এর বাবা ছেলের গানের প্রশংসা করেন। তিনি বলতেন তুমি চেষ্টা করলে অনেক বড় হবে। বিশেষ করে তার মায়ের দোয়া ছিলো অকল্পনীয়। কারণ শিল্পী মশিউর রহমান ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা, খেলাধুলার পাশাপাশি তার মায়ের কাজগুলোর প্রতি ছিলেন বিশেষ মনোযোগী। তিনি মায়ের কথা শোনা, সেবা করা, নামাজ পড়া, ঘর মোছাসহ এমনকি মায়ের কাঁথা ধোয়ার কাজও করে দিতেন ভীষণ আনন্দের সাথে।
শিল্পী মশিউর রহমান এর মমতাময়ী মা একদিন ঘুম থেকে উঠে তাকে এক গ্লাস পানি দিয়ে বলেছিলেন তুমি একদিন মাশহুর বান্দা হবে। কলিজার টুকরো আদরের সন্তানের জন্য এমন উচ্চ বিলাসী দোয়া করেছিলেন শিল্পীর মহিয়শী মা। শিল্পীর যৌবন বয়সে পাওয়া মায়ের সেই দোয়া শিল্পী হৃদয়ের অতলান্তে লালন করতে থাকেন। মায়ের দোয়া এবং বাবার আদর অনুপ্রেরণা তাকে এই জগতের পথিকৃৎ হওয়ার খোঁড়াক জোগায়।
ছোটবেলায় যখন তার বাবা ফজর নামাজে ডাকতেন তখন ছেলের ঘুম ভাঙাতে দরাজ গলায় গাইতেন “তুমি রহমান তুমি মেহেরবান/ অন্ধ গাহে না শুধু তোমারই গুণগান” এই বিখ্যাত হামদে বারী তায়ালা। এরকম গান শুনেই ঘুম ভাংতো কিশোর শিল্পী মশিউর রহমান এর। নামাজ শেষে কৌতূহল মনে বাবার কাছে জানতে চেয়ে নানান প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে হাজির হতেন শিল্পী মশিউর রহমান। বাবার কাছে তার প্রশ্ন ছিলো- এতো সুন্দর গান কে লিখেছে? কে গেয়েছে? কে সুর করেছে! বাবার জবাব ছিলো তুমি বড় হলে এরকম সুন্দর সুন্দর গান গাইতে পারবে ইনশাআল্লাহ।
বাবা মায়ের পরম আদর স্নেহ এবং সহযোগিতায় পড়াশোনা ও ইসলামি সংগীত চর্চার মধ্য দিয়ে মফস্বলে বেড়ে উঠতে থাকেন শিল্পী মশিউর রহমান। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার টেপাখোলা নামক মফস্বল গ্রামে একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম। তিনি ৫ ভাই ১ বোনের মধ্যে সবার বড়। তার পিতামহ ছিলেন ততকালীন রেলওয়ে গার্ড। তার বাবার নাম মোস্তাফিজুর রহমান ফরিদ মিয়া। মায়ের নাম শামসুন নাহার। তিনি ফরদিপুর সরকারি বৈরাগী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমকি শিক্ষা লাভ করেন। ফরিদপুর পুলিশ লাইন স্কুলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করে ফরিদুপুর হাইস্কুল থেকে কৃতিত্ত্বের সাথে মেট্রিক পাশ করেন। বিএ পাশ করেন ফরিদপুর সরকারী কলেজ থেকে ।
অসাধারণ কণ্ঠের এই যাদুকর শিল্পী ছোট থেকে যেমনি ছিলেন গানের পাখি তেমনি পড়াশোনায়ও ছিলেন বেশ মনোযোগী। তাইতো নিজ জেলা পেরিয়ে এবার উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববদ্যিালয়রের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিযোগিতার অডিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাফল্যের ঝুড়ি ভারী করতে থাকেন। তখন থেকেই তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ আর অমায়িক সুর শুনে বন্ধুরা সংগীতাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরামর্শ দেন। যার ফলে তিনি ইসলামি সংগীতকে ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেন।ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুবাদে তিনি সুযোগ পান ইসলামি সাংস্কৃতিক জগতের পথিকৃত সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীতে। তিনি একাধারে ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনে কাজ করেন এবং একজন প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সংগীত শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিতি করেন। ঢাকায় সাইমুমে কাজ করার আগেই দেখা পান সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা কবি মতিউর রহমান মল্লিক এর সাথে। ১৯৭৮-৭৯ সালে কবির সাথে তার নিজ জেলা ফরিদপুরে সাক্ষাত হয় শিল্পী মশিউর রহমান এর। এরপরে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের সাথেকাজ করেন ইসলামী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার অন্দোলনে। তিনি এ পর্যন্ত ৩ হাজারের অধিক গানে সুর করেছেন যা ইসলামী সংগীতাঙ্গণে খুবই বিরল ঘটনা।
ইসলামী সংগীতকে আরও বেগবান করতে তিনি ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘টুনটুনিদের আসর একাডেমি। যার মাধ্যমে তিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন হাজার হাজার শিশু কিশোর শিল্পীদের।বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত অনেক শিল্পী তারই হাতে গড়া। প্রশিক্ষণ একাডেমির পাশাপাশি তিনি ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মার্জিন রিদম রেকর্ডিং স্টুডিও। শিল্প সংস্কৃতির পাশাপাশি তার রয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিগত ২৬ বছর যাবত তিনি ফাতিমা হিজাব এন্ড ফ্যাশন এর স্বত্বাধিকারী হিসেবে নিজ ব্যবসা পরিচালনা করছেন ।
শিল্পী মশিউর রহমান ও সবার থেকে ব্যতিক্রম নন। তাকেও হাতছানি দিয়েছিল অপসংস্কৃতি। নফসের ধোঁকায় তিনিও বাঁকা পথের সন্ধ্যান পেয়েছিলেন। কিন্তু তার ভেতরে গেঁথে যাওয়া সুস্থ সংস্কৃতির শেকড় উপড়াতে পারেনি অপসংস্কৃতির হাতছানিতে। তিনি বারবার কল্যাণের পথে, সুন্দররের সাথে শামিল করে নিজেকে হেফাজত করেছেন। সবসময়ই তার আকূলতা ব্যাকূলতা ছিল ঈমানের পথে থাকার। শিল্পীর সেই আকুতি মহান আল্লাহ কবুল করেছেন।
বর্তমান সময়ে কোনো ধরনের বাধ্যযন্ত্রবিহীন সংগীত দিয়ে গণমানুষের মনোরঞ্জন করাটা খুবই কঠিন একটি কাজ। তবে এই দুঃসাধ্যকেই জয় করেছেন শিল্পী মশিউর রহমান। দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে গিয়েছেন ইসলামি সংগীত অনুষ্ঠানে। ইসলামী সংগীতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এর জন্য ইতিমধ্যে তিনি সফর করেছেন অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, দুবাইসহ কয়েকটি দেশে। সুরে সুরে মুগ্ধ করেছেন লক্ষ লক্ষ ইসলামপ্রিয় তৌহিদী মানুষকে। আল্লাহর দেয়া সুস্থ সংস্কৃতির রং এবং রস কতটা অপ্রতিরোধ্য সেটা খালি গলায় ইসলামি সংগীত গেয়ে মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন ইসলামী গানের সুর সম্রাট শিল্পী মশিউর রহমান।
বর্তমানে শিল্পী মশিউর রহমান ঢাকায় বসবাস করেন। তিন কন্যা সন্তানের জনক। তার তিন কন্যা হলেন- খাদিজা মুমতাহিনা,মুজতাহিদা আফরিন ও রুশদা রহমান ফিহা।