মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩, ২০২৪
Motiur rahman Mollik
Motiur rahman Mollik

ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ কবি মতিউর রহমান মল্লিক

মোশাররফ মুন্না ॥

মতিউর রহমান মল্লিক বাংলাদেশের এক সুপরিচিত ইসলামী সঙ্গীতশিল্পী। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় তিনি সমমনা সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহ্যবাহী সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী। যিনি একাধারে একজন কবি, শিল্পী, আবৃত্তিকার, গীতিকার, সুরকার ও সতন্ত্র ধারার সংগঠক। তিনি শৈশব থেকেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এর পর তিনি দেশের বিভিন্ন শহর, গ্রাম, নগর, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদরাসায় অনুপ্রাণিত করে বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে, যেখানে বাংলাভাষী মুসলমানরা আছেন, সেখানেও তাঁর অনুপ্রেরণায় একই ধরনের সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। তার এই কর্মের পিছনে মিূল নায়ক ছিলেন শহীদ মীর কাশেম আলী।

মল্লিক তার প্রাথমিক শিক্ষা বারুইপাড়া সিদ্দীকিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় সমাপ্ত করেন। এরপর বাগেরহাট পিসি কলেজ থেকে উ”চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন এবং পরবর্তীতে জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

মতিউর রহমান মল্লিক ১৯৫৪ সালের ১ মার্চ বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার বারুইপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুন্সি কায়েম উদ্দিন মল্লিক ছিলেন একজন গীতিকার, যিনি স্থানীয় জারীগানের দলের জন্য গান লিখতেন। তার মাতা আয়েশা বেগম। তৎকালীন রেডিওতে কবি ফররুখ আহমদ পরিচালিত সাহিত্য আসরে মল্লিকের বড় ভাই কবিতা আবৃত্তি করতেন। পিতা-মাতার সান্নিধ্যে থেকে মল্লিকের গানের প্রতি আগ্রহ জন্মায় এবং তিনি প্রাথমিকভাবে গান শিখতে শুরু করেন। রেডিওতে গান শুনে তার প্রাথমিক জীবনে গানের প্রতি ভালোবাসা বাড়ে এবং সে সময়ের বেশিরভাগ গানই ছিল প্রেমের গান। পরবর্তীতে ইসলামী আদর্শে প্রভাবিত হয়ে তিনি ইসলামী ধারায় গান লেখা শুরু করেন।

তিনি ছিলেন দার্শনিক কবি শহীদ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা. এর এক নিবেদিত ভক্ত, আর অন্যদিকে দার্শনিক কবি মহাকবি ইকবালের কাব্য প্রতিভার অনুসারী। তিনি মাওলানা মওদূদী রহ. এর বিশ্ববিখ্যাত তাফহিমুল কুরআন এবং তাঁর অন্যান্য সাহিত্য রচনাসমূহ থেকে অফুরন্ত জ্ঞান আহরণ করেছেন।

১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া সমস্ত ইতিহাস তাঁর সামনে ছিলো। সেই চিন্তাকে সামনে রেখে তিনি সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করেন বরিশালের ঐতিহ্যবাহী হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠী, চট্টোগ্রামের বিখ্যাত পানজেরী শিল্পীগোষ্ঠী, সিলেটের দিশারী শিল্পীগোষ্ঠীসহ অসংখ্য সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। যা পরবর্তীতে ছড়িয়ে পরে জেলা থেকে উপজেলা পর্যন্ত।

তার লেখা জনপ্রিয় কিছু সংগীত হলো- তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর, টিক টিক টিক টিক যে ঘড়িটা, রাসুল আমার ভালবাসা, পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়, এলো কে কাবার ধারে, সে কোন বন্ধু বলো, আম্মা বলেন ঘর ছেড়ে তুই , এ আকাশ মেঘে ঢাকা রবে না, কথায় কাজে মিল দাও আমার, এসো গাই আল্লাহ নামের গান, হঠাৎ করে জীবন দেওয়া খুব সহজ, আয় কে যাবি সঙ্গে আমার, গান শোনাতে পারি, আন্দোলন সে জীবনের অন্য নাম, যদি কেউ বুঝে থাকো, এত শহিদ রক্ত ঢালে, ধৈর্য ধারণ করার শক্তি দাও, যা কিছু করতে চাও, এখানে কি কেউ নেই, ঘন দুর্যোগ পথে দুর্ভোগ, এই দূর্যোগে এই দূর্ভোগে আজ, চলো চলো চলো মুজাহিদ, একজন মুজাহিদ কখনও বসে থাকে না, সাহসের সাথে কিছু স্বপ্ন জড়াও, সংগঠন কে ভালবাসি আমি, কার কতটা ঈমান আছে, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ বীর মুজাহিদ জিন্দাবাদ, আমার গানের ভাষা জীবনের সাথে যেন, কোন সাহসে চাও নেভাতে অগ্নিগিরি বল, দৃষ্টি তোমার খুলে রাখো, রোদের ভিতর ইলশে গুড়ি, হে খোদা মোর হৃদয় হতে, জিহাদ করতে চাই আমি, সারা বাংলার গ্রামে গঞ্জে, এই গুনাহগার প্রভু, মনটাকে কাজ দিন, রাতের আঁধার কেটে কেটে এছাড়া আরও অসংখ্য জনপ্রিয় গানের অমর সৃষ্টির শিল্পী তিনি।

তার লেখা প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থ’- নীষন্ন পাখির নীড়ে (কাব্যগ্রন্থ): আত্ম প্রকাশন, সুর-শিহরণ (ইসলামি গানের বই), যত গান গেয়েছি (ইসলামি গানের সঙ্কলন), ঝংকার (গানের বই), আবর্তিত তৃণলতা (কাব্যগ্রন্থ) মোনালিসা প্রকাশন, তোমার ভাষার তীক্ষ্ণ ছোরা (কাব্যগ্রন্থ) বাংলা সাহিত্য পরিষদ, অনবরত বৃক্ষের গান (কাব্যগ্রন্থ) মোনালিসা প্রকাশন, চিত্রল প্রজাপতি (কাব্যগ্রন্থ) প্রফেসর’স পাবলিকেশন্স, নির্বাচিত প্রবন্ধ (প্রবন্ধের বই), রঙিন মেঘের পালকি (ছোটদের ছড়ার বই) জ্ঞান বিতরণী, প্রতীতি এক (ইসলামি গানের ক্যাসেট), প্রতীতি দুই (ইসলামি গানের ক্যাসেট), প্রাণের ভিতরে প্রাণ (গীতিকাব্য) উল্লেখযোগ্য। তাঁর অনুবাদ কাজের মধ্যে পাহাড়ি এক লড়াকু যা আফগান মুজাহিদদের বীরত্বপূর্ণ কীর্তি নিয়ে লেখা, বিশেষভাবে জনপ্রিয়। কিশোর কণ্ঠের পাঠকরা নিয়মিতভাবে এই উপন্যাসটি পড়তেন। এছাড়া, মহানায়ক উপন্যাস ছাড়াও, তিনি হযরত আলী ও আল্লামা ইকবালের মতো বিশিষ্ট মুসলিম কবিদের কবিতার অনুবাদ করেছেন।

কবি মতিউর রহমানের সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। সাহিত্য পুরস্কার : সবুজ-মিতালী সংঘ বারুইপাড়া, বাগেরহাট। কলমসেনা সাহিত্য পুরস্কার, ঢাকা। লক্ষ্মীপুর সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, রাঙামাটি সাহিত্য পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম। খানজাহান আলী শিল্পীগোষ্ঠী, বাগেরহাট, সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ, সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ, বাগেরহাট, স্বর্ণপদক : জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা, প্যারিস সাহিত্য পুরস্কার : বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ, বায়তুশ শরফ সাহিত্য পুরস্কার : বায়তুশ শরফ আনজুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম, ইসলামী সংস্কৃতি পুরস্কার : ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ, চট্টগ্রাম, সাহিত্য পুরস্কার : বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ফ্রান্স, ও কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার।

২০১০ইং সনের ১১ জুলাই ডায়ালাইসিস শেষে বাসায় ফেরার পরপরই তার কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট হয়। প্রায় ২৫ মিনিট শ্বাস বন্ধ-মৃত প্রায় অবস্থা হলে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দিয়ে কয়েক ঘণ্টা তাকে ইবনে সিনা হাসপাতালে রাখা হয়। পরে নেয়া হয় স্কয়ার হাসপাতালে। তারপর ২১ জুলাই স্কয়ার হাসপাতালে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের জন্য ৫ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। উল্লেখ্য, কবি মতিউর রহমান মল্লিককে ব্যাংকক থেকে হার্টে ৫টি রিং সংযোজন করে দেশে নিয়ে আসার পর বাসায় রেখে সপ্তাহে ৩দিন তাকে ইবনে সিনায় রেখে ডায়ালাইসিস করানো হতো।

এভাবে ১ বছর পর পুনরায় ব্যাংককে নিয়ে কিডনী সংযোজনের কথা ছিল। হঠাৎ করেই কাডির্য়াক এ্যারেস্টের ঘটনা ঘটনায় কবি মল্লিক ডীপ কোমায় চলে যান। কবি মতিউর রহমান মল্লিক ২০১০ সালের ১২ আগষ্ট ইন্তকোল করেন । মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে কবির ভক্তদের মাঝে। তার পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে বিদেশে বসবাস
করছেন।

আরো পড়ুন

apu-bubly

বুবলীকে টয়লেট দিবসের শুভেচ্ছা অপু বিশ্বাসের!

বিনোদন ডেস্ক।। শবনম বুবলীর জন্মদিনকে কেন্দ্র করে অপু বিশ্বাস ও শবনম বুবলীর কোন্দলের চিত্র আরও …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *