শুক্রবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৫

মহাবীর মুহাম্মাদ বখতিয়ারের বঙ্গবিজয়ের ৮২০ তম বার্ষিকী

আযাদ আলাউদ্দীন ।।

আজ ১০ মে, মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয়ের ৮২০ তম বার্ষিকী। ১২০৫ সালের ১০ মে তিনি লক্ষ্মণাবতী জয় করেন। পরবর্তীতে এ শহর লখনৌতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মুসলিম শাসনামলে ১৩৪২ সাল পর্যন্ত লখনৌতি বাংলার রাজধানী ছিলো। লক্ষ্মণাবতীর আগে বখতিয়ার নদীয়া জয় করেন। এর আগে তিনি ১২০৩ সালের সূচনায় বিহার জয় করেন। বখতিয়ার বিহার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের স্বাভাবিক পথ প্রত্যাখ্যান করে ঝাড়খন্ডের স্বাপদসঙ্কুল দুর্গম অরণ্যাঞ্চলের ভেতর দিয়ে নদীয়া পৌছেন। তার মূল বাহিনী ছিলো পিছনে। এটা ছিলো যুদ্ধের স্ট্রাটেজি। ১৭ জন ঘোড়সওয়ার সৈন্য সহযোগে ঘোড়া ব্যবসায়ীর ছদ্মাবেশে মধ্যহ্নভোজনের সময় অতর্কিতে রাজপ্রসাদে অভিযান পরিচালনা করেন। আতঙ্কিত রাজা লক্ষ্মণ সেন দিগি¦দিক হারিয়ে খিড়কির দরজা দিয়ে নৌপথে বর্তমান মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন। একবিংশ শতাব্দীর শেখ হাসিনা ও আর ত্রয়োদশ শতাব্দীর লক্ষ্মণ সেন উভয়ের শেষ পরিণতি একই।

বখতিয়ার খলজি ছিলেন স্বাধীন অ্যাডভেঞ্চার এবং দুঃসাহসিক অভিযানকারী। ইনসাফভিত্তিক সমাজ কায়েমেও তিনি অদ্বিতীয়। স্বল্পসংখ্যক সঙ্গী নিয়ে বিপ্লব ছিনিয়ে নেওয়া তাঁর সুতীক্ষ্ম মেধার স্বাক্ষর। অসাধারণ সমরকৌশল, তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা এবং কুটনীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ায় অসাধ্য সাধিত হয়েছিল। চৌকষ গোয়েন্দা বাহিনী অভিযানে মূল ভূমিকা রাখে। ইতিহাসবেত্তা ড. মোহাম্মদ হাননান জানান, ‘বখতিয়ার খলজির বঙ্গ অভিযান: বাঙালির ইতিহাসে নতুন ধারার সূচনা। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, বাংলার এই প্রথম মুসলিম শাসনকর্তা কখনোই অত্যাচারী ছিলেন না। মধ্যযুগের ইতিহাসের জনক বখতিয়ার খলজি নিজের থেকে বাংলার সুলতান উপাধি গ্রহন করেননি। তবে খলজি বংশের সুলতান গিয়াস উদ্দিন আইওয়াজ (১২১৩-২৭) দিল্লির অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন নরপতি হিসেবে ১২ বছর বাংলা শাসন করেন। ফলে তিনি ইতিহাসে লাভ করেন বাংলার প্রথম সুলতানের মর্যাদা। গিয়াসউদ্দিনের এই ক্ষমতা গ্রহণ এবং তাঁর পরবর্তী ঘটনাবলি প্রমাণ করে মধ্যযুগে ভারত ও বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলমানদের অভিযান নিছক রাজ্য জয় ছিলো না। ছিলো সুপরিকল্পিতভাবে ইসলাম অভিযান।’ তাই বলা যায়, বখতিয়ার খলজিই বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি জাতিসত্তার প্রকৃত নির্মাতা।

ইতিহাসের দিগি¦জয়ী জেনারেলদের একজন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি। মাত্র সপ্তদশ সৈন্য নিয়ে একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাষ্ট্রবিজয়ের একমাত্র কৃতিত্ব বখতিয়ার খলজির। তাইতো বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিপ্লব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। সমাজ ও রাষ্ট্রবিপ্লবের এ ধরনের নজির ইতিহাসে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাঙালি জাতি, বাঙালি সভ্যতা ও বাঙালির রাষ্ট্র গঠনের শ্রেষ্ঠ নির্মাতা বখতিয়ার খলজি। বখতিয়ার খলজি বঙ্গবিজয়ে বিফল হলে সেটা হতো বাঙালির ব্যর্থতা, বাঙালি সভ্যতার ব্যর্থতা, বাংলাভাষার ব্যর্থতা। বখতিয়ারের আগমন না হলে সুলতানি ও নবাবি আমলের সমৃদ্ধশালী অর্থনীতির সংস্পর্শে আসতে পারত না বাংলাদেশ। সৃষ্টি হতোনা বিশ^ ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বয়নশিল্প মসলিন। গড়ে ওঠত না সোনারঁগাও, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ, বাকলা-বাঙ্গালার মতো বড় বড় বাণিজ্যকেন্দ্র। শুধু তাই নয়, বাংলাভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি হারিয়ে যেত সেই ত্রয়োদশ শতকেই। ড. মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহর মতে, ‘জানিনা কতদিন বাঙ্গবাণী জন্মিয়া ঘরের কোণে লাজুক বধূটির মত নিরিবিলি বাস করিতেছিল। সে দিন বাঙ্গালার অতি স্মরণীয় সুপ্রভাত, যে দিন সে সাহিত্যের বিস্তীর্ণ আসরে দেখা দিল। বাস্তবিক সেদিন বাঙ্গালীর এক নবযুগের পূণ্যাহ। … যাঁহারা বলিয়াছিলেন- অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ। নিশ্চয় তাহারা বাংলা ভাষাকে আবাহন করে আনেন নাই। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিপক্ষেরাই সনাতনপন্থিগণকে বিমোহিত করে বেদমার্গ হইতে ভ্রষ্ট করিবার জন্যই এই মোহিনী বঙ্গবাণীর সাধনা করিয়াছিল। পরে স্বার্থের খাতিরে লৌকিক দেবতার পূজকরাও তাহাদের সহিত যোগ দিয়াছিল।’ ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজিই ছিলেন বাংলাভাষার পুনর্জন্মদাতা, সংরক্ষক ও প্রমাণক। বখতিয়ারের সূত্রেই শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যের জনক।

উপনিবেশোত্তর ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানভুক্ত হয়। এটি ছিলো বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ। এই সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় প্রতীয়মান হয় বখতিয়ার খলজিই জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের বুনিয়াদি স্থাপতি। বখতিয়ারের আবির্ভাব না হলে, বাংলাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ সম্ভব হতো না। আর অমুসলিম গরিষ্ঠ হলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিলো তিরোহিত। তখন বাংলাদেশ ভারতীয় গর্ভে নিমজ্জিত হয়ে নিরবে-নিভৃতে দিল্লির অত্যাচার বয়ে বেড়াত। বখতিয়ারই ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান কর্ণধার বা কান্ডারি। তাই বলা যায়, ইসলামই বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের একমাত্র গ্যারান্টি।

আরো পড়ুন

‎গৌরনদীতে অজ্ঞাত পরিবহনের ধাক্কায় নিহত-১

সোলায়মান তুহিন গৌরনদী প্রতিনিধি।। ‎বরিশাল–ঢাকা মহাসড়কের গৌরনদী উপজেলার সাউদের খালপার এলাকায় দ্রুতগামী অজ্ঞাত পরিবহনের ধাক্কায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *