শুক্রবার, ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪

মদনপুরে মাঝের চরে 

মো. মহিউদ্দিন ॥
ভোলা সদর সীমানার পূর্বপাশে প্রবাহিত মেঘনা নদীতে জেগে ওঠে চর, স্থানীয় লোকজন বলতেন ‘ মাঝেরচর ‘। কাগজ-কলমে চরটির নাম মদনপুর। নদীর কূলে দাঁড়ালে মাঝের চরকে জলের মধ্য ভেসে উঠা কচ্ছপের পিঠের মত কালো রঙের দেখাতো। পলি মাটি আর বালু সাথে খড়কুটো , তৃণ্ন লতা, গাছগাছালি মিশে তৈরি হয়েছে খুবই উর্বর এ বিরানভূমি। জনমানবহীন এক বিরানভূমি। এ চরে জলচর পাখিরা অভয় আশ্রম গড়ে তুলেছে। অসংখ্য বড় বড় ইদুরের বাস। স্থানীয়দের ভাষায় এদেরকে ‘কডা’ বলে, দেখতে অনেকটা বিড়ালের মত বড়। চরের বুকে কলকল ছলছলে বয়ে চলছে ছোট ছোট অসংখ্য খাল।
জোয়ারের সময় এসব খাল পানিতে পূর্ণ হয়ে গেলেও কোথাও কোথাও খাল শুকিয়ে যায় মাঝে মাঝে হাঁটু জল থাকে । এসব খালে অসংখ্য নানান জাতের মাছে কিলবিল করে, বহু বছর ধরে নির্ভয়ে বাস করছে । এসব মাছ ধরার কোন মানুষজন নেই। জনমানবহীন  এক চরাঞ্চল। মাঝে মাঝে হোগলা পাতার দল হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে সগৌরবে। চর ভেঙ্গে গেলে এসব হোগলা পাতার দল নদীতে ভেসে ভেসে  নতুন চড়ে বাসা বাঁধে।  হোগলা পাতা গ্রাম্য লোকজনের খুবই নিত্য প্রয়োজনীয় উপকারী একটি গাছ। হোগলা পাতা দিয়ে শুইবার বিছানা তৈরি, নামাজের বিছানা তৈরি ও হাতপাখা তৈরি হয় ।
হোগলা গাছে এক জাতীয় লম্বা আকৃতির ফুল ফোটে। হোগলার পরাগ রেনু মজাদার একটি খাবার । ভোলা জেলার স্থানীয় ভাষায় এ  পরাগ রেনুকে ‘হোগল’ বলে। হোগল গুড় অথবা চিনির সাথে দুধ দিয়ে রান্না করলে এর  মৌ মৌ ঘ্রাণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে । খেতে খুবই সুস্বাদু হোগল দেখতে অনেকটা হলুদের গুঁড়ার মত । মাঝে মাঝে শহরেও বাঁশের টুকরিতে করে হোগল পাউডার বিক্রি করতে দেখা যায় । অবশ্য এখন বাজারে খুব উচ্চমূল্য বিক্রি হয়,কারণ এটি অভিজাত শ্রেণীর একটি সুস্বাদু খাবারে পরিণত হয়েছে।  আমি প্রতি বছরই এই হোগলের স্বাদ আস্বাদন করে থাকি। আমার একটি মজাদার খাবার হোগল।
অবশ্য বিজ্ঞানের ভাষায় হোগল পাউডার খুবই পুষ্টিকর। হোগলের ফুল থেকে  একপ্রকার মিহি তুলা পাওয়া যায়, যা দিয়ে বালিশ তৈরি করা হয়। আগের দিনের গ্রাম্য মানুষজন হোগলা পাতা দিয়ে ঘরের পাটিসন তৈরি করতেন। হোগলা পাতা জ্বালানি হিসেবে খুব ভালো। চরাঞ্চলের অসহায় মানুষজন কোন খাবার সামগ্রী না পেলে হোগলা পাতার গোড়া কচু তরকারির মত কেটেকুটে রান্না করে খেতেন।সম্প্রতি এই হোগলা পাতা কুটির শিল্প হিসেবে দেশ-বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে ।
গ্রাম্য হতদরিদ্র মেয়ে অথবা গ্রাম্য বধুদের প্রায়ই দেখা যায় হোগলা পাতা দিয়ে রশি বুনতে। এসব রশি বেপারীগণ গ্রামে হেঁটে হেঁটে তাদের কাছ থেকে পারিশ্রমিক দিয়ে বুনিয়ে নেন। অনেক সময় এদেরকে রশি বুনার জন্য অগ্রিম দাদন দিয়ে থাকেন। আধুনিক এ সভ্যতায়ও জানান দিচ্ছে– আমি কিন্তু তোমাদের সাথে আছি আধুনিকতা নিয়ে। মাঝেরচরটির পশ্চিম পাড়ে ভোলার সীমানা, পূর্ব পাড়ে নোয়াখালী । মাঝের চরটি সোজাসুজি চলে গেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। মেঘনা নদীর মাঝে প্রায় ছোট ছোট বালুরচর ভেসে উঠে, জোয়ারের সময় ডুবে গেলেও ভাটার সময় দেখা দেয় এসব চর । আবার নদীর প্রবল স্রোতে ভেঙে যায় এসব অস্থায়ী চর। মুহূর্তের মধ্য অদৃশ্য হয়ে যায় প্রবল স্রোতে পানির আড়ালে।
লোকজন বলাবলি করেন-  এই এখানে একটি চর ছিল না ! মেঘনার প্রবল স্রোতে করাল গ্রাসে ভাঙ্গে ভোলা, ভাঙ্গে নোয়াখালী। দু’কূল সমানতালে  বিরামহীন ভাবে ভাঙতে থাকে। মাঝে মাঝে জিরিয়ে নেয় তখন দুকূলের মানুষজন একটু স্বস্তি পায়। এবারের মাঝেরচর একটু স্থায়ী হবে বলে স্থানীয়দের আশা। মেঘনা নদীর পাড়ের লোকজন বলাবলি করেন– এবারের চর থাকবো। আশা করি আমরাও বসত করতে পারমু। গ্রাম্য যুবক আলি আহাম্মদ মাল এক বুক আশা নিয়ে বেঁচে থাকার শেষ  অবলম্বন হিসেবে ছোট ছোট আট দশ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে জেলেদের মাছ ধরার নৌকায় করে মাঝের চরে স্বপ্নের নীড় গড়ার  হাসি, কান্নার এক করুন কাহিনী।
বৈরী পরিবেশে অনেক  প্রতিকূলতার মধ্যে বেঁচে থাকার এক জীবন কাহিনী। আলী আহাম্মদ মাছ ধরার নৌকায় করে  চরে মাটিতে প্রথম দিন পা দিয়েই দেখেন এক বিরান  ভূমি, কোন প্রাণীকুলের অস্তিত্ব নেই ।
গা ছমছম করে ওঠে আলি আহাম্মদের। গাং চিলের দল তাদের মাথার উপর দিয়ে চক্কর দিতে থাকে।
হয়তো তারা ভাবছে, এই তোমরা কারা? আমাদের চরে কেন এসেছ ?এটা আমাদের বাড়ি ,এখানে তোমাদের কোনো আশ্রয় নেই । দ্রুত চলে যাও আমাদের পাখি নীড় থেকে।
আলী আহাম্মদ  আকাশের দিকে চেয়ে অপলক দৃষ্টিতে চক্রাকৃতির উড়ন্ত জলচর পাখিদের দেখতে থাকে। ওরা দিনে রাতে কিচিরমিচির ডাকে মুখরিত করে মেঘনা নদী ও মাঝের চরটিকে।  বংশ পরম্পরায় চলছে এ জলচর পাখিদের জীবনধারা।  আলী আহাম্মদ ভাবে যেহেতু আশপাশে কোন মানুষজন নেই , হয়তো এই পাখিরা হবে আমাদের নিত্যদিনের প্রতিবেশী। আলি আহাম্মদ তার স্ত্রী আরফুজা বেগমকে বলেন —  দেখছো আশপাশে কোন মানুষ নাই, কোন বসতি নাই। কেমন কইরা থাকুম এই বিরান  চরে ? আরফুজা বেগম বলেন — আল্লাহর উপর ভরসা করেন। আল্লাহ আছে আমাগো লগে। তুমি কোন চিন্তা কইরো না আমাগো পোলাপাইন আছে না আমাগো লগে। সবে মিলেমিশে থাকমু নে।
আল্লাহ আমাগো পোলাপাইন সব কিছুই দেখবো । তুমি আল্লাহর উপর ভরসা রাইখ। আইও আমরা ঘর বানাই।
শীতের দিন এই মাঝের চরে মাত্র ১০-১২ টি  প্রাণ ।
ছোটমেয়ে রেবু বিবি শীতে থরথর করে কাঁপছে ।
মা আরফুজা বেগম একটি কাঁথা মুড়িয়ে দেয় মেয়ের গায়ে ।
একটু পরে সূর্যের তাপ বাড়তে থাকে আলী আহাম্মদ কাঁচতে  দিয়ে অনেকগুলো হোগলা পাতা কেটে ছোট ছোট আঁটি বেঁধে দেন, ছেলে মেয়েরা পাল্লা দিয়ে আঁটিগুলো এক জায়গায় এনে জড়ো করতে থাকে। এভাবে চলে কয়েক ঘন্টা হোগলা পাতাকাটা ।
আলী আহাম্মদের ছেলে-মেয়ে ছোট ছোট হলে কী হবে সকলেই কর্মঠ।
আলী আহাম্মদ চরে আসার সময় সাথে করে অনেকগুলি বাঁশের কঞ্চি ,চিকন বাঁশ কিছু রশি নিয়ে এসেছিলেন তা দিয়ে তিনি ছেলে মেয়েদের সাথে নিয়ে ঘরের পাটিশন তৈরি করেন ।
আলী আহাম্মদের বড় ছেলে আমানুল্লাহ আমান এবং কালিমুল্লাহ দুই ভাই মিলে খালের মধ্যে অল্প পানিতে অনেক মাছ দেখতে পেয়ে, খাল থেকে বাটি দিয়ে পানি সেচে বেশ কিছু কিছু চিংড়ি, চেউয়া, পুঁটি, মাছ ধরে নিয়ে আসে ।
 অনেকগুলো মাছ দেখে সকলে মহাখুশি। আলী আহাম্মদ আসার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন কিছু নিত্য পণ্য শুকনো খাবার চিরা, লবণ ,হলুদ ,মরিচ, কেরোসিন ,সরিষার তেল, তিল তেল দা-বটী হাড়ি পাতিল খাবার মাটির খোড়া।
 মাছগুলো কেটেকুটে রান্না করে আমানের মা আরফুজা বেগম।
সকলে পেটপুরে শুধু রান্না করা মাছ খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে।
সূর্যের আলো কমতে থাকে। শীতের প্রকোপ বাড়তে থাকে অন্ধকার নামে চারিদিকে । থেকে যায় শুধু পাখিদের আওয়াজ।
কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় মাঝেরচর। গাংচিল, নানান জাতের বুনো হাঁস ,বেলে হাঁস, সামুক খোচা, চকোর চকরি নানান জাতের রংবেরঙের জলচর পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মাঝেরচর।
আলী আহাম্মদের পরিবারের সকলে হোগলা পাতায় তৈরি ঘরের মধ্যে হোগলা পাতার বিছনা বিছিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন।
সারাদিনের ক্লান্তিতে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়েন সকলে। কিন্তু আমান ও কালিমুল্লাহ দুই ভাই দুরন্ত বালক তাদের ঘুম আসে না।
আমান নানান জাতের বুনো হাঁস জলচর পাখি দেখে হতবাক হয়ে যায়।
হাঁসগুলোর পিছে দৌড়াতে
থাকে দুই ভাই ।
ঝাঁকে ঝাঁকে হাজার হাজার পাখি ।আমান এবং কালিমুল্লাহ কে দেখেই পাখির দল এক জায়গা থেকে উড়ে অন্য জায়গায় যেয়ে হাঁটু জলের পড়ে ছোট ছোট মাছ ধরে খায় আর কিচিরমিচির ডাকে। এসব পাখি আকাশে উড়ার সময় অথবা পানিতে জলকেলির সময় কালো মেঘের মতো দেখায়।
আমান এবং কালিমুল্লাহ নাছোর বান্দা পাখিদের পিছে দৌড়াতে থাকে। অন্ধকারের মধ্যে একটি বড় আকারের বেলে হাঁস ধরে ফেলে আমান হাঁসটির ডানা সজোরে চেপে ধরে আমান ডাক দেয় ভাইকে দু’ভাই মিলে চেপে ধরে ।হাঁসটি প্রাণপণে ডানা ঝাপটায়  চেষ্টা করেছিল তাদের হাত থেকে ছুটে যাওয়ার জন্য।
দুই ভাইয়ের  গায়ে কয়েকটি ঠোকর মেরেছিল , আমান চোখ সাবধান রেখে হাঁসটি কাদা মাটিতে চেপে ধরে ঘাড় মটকিয়ে দেয়। এতে হাঁসটি ছটফট করতে থাকে মুমূর্ষ অবস্থায় ।
হাঁসটি ওদের ছোট্ট কুঠিরের কাছে নিয়ে আসে দুই ভাই। আমানের মা ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে ছেলেদের হাতে সাদা রঙের একটি বড়োসড়ো বুনোহাঁস।
সকলে খুশিতে ফেটে পড়ে ।তাড়াতাড়ি দা এনে হাঁসটি জবাই করে ফেলে আমানের মা। আরফুজা বেগম বলেন- এডি বড় বাদি আস।
ঘরের মধ্যেই হাঁসটি কেটেকুটে ফেলে প্রায় পাঁচ ছয় কেজি মাংস হয়। সকলে মহা খুশি । রাতের বেলায় চলতে থাকে  রান্না সাথে অল্প কিছু চাল চুলায় চড়িয়ে দেন ,ভাত রান্না হয়।
হাঁসের মাংস আর ভাত সকলে খেয়ে মহা খুশি ,এ যেন এক অমৃত খেয়েছে সকলে। আলী আহাম্মদ তার স্ত্রীকে বলে– দেখছো আমানের মা, হাঁসটিতে কত তেল হইছে। মেয়ে পারু বিবি বলে– খুব মজা লাগছে বাবা।
রাতে খাবার খেয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন আলী আহাম্মদ । রাতে খসখস শব্দের ঘুম ভাঙ্গে আমানের। হোগলা পাতার দরজা একটু ফাঁক করে চেয়ে দেখে সারা চড়ে অসংখ্য বড় বড় ইঁদুর স্থানীয় ভাষায় এদেরকে ‘কডা’ বলে। আমানের উঠার শব্দ পেয়েই ইঁদুরের দল ছিটকে লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়দেয় চতুর্দিকে ।
আমান আবার ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমান বলে– বাবা জানো রাইতে অনেক বড় বড় ইঁন্দুর দেখছি এক একটা বিলাইর মতন ।
আলী আহাম্মদ বলেন- এগুলি কডা অনেক বড় বড় অয় ।
আমান সকালে ঘুম থেকে উঠে শুকনো হোগলা পাতা কুড়িয়ে এনে  আগুন ধরিয়ে দিয়ে সকলে আগুন পোয়ায় শরীর গরম করে নেয়।
আমানের মা-বাবা ভাই-বোন সকলে মিলে আগুনে চারদিকে বসে হাত উঁচিয়ে দুহাতে তাপ নিতে থাকে শরীর উষ্ণ হয়। ধীরে ধীরে পূর্ব আকাশে সূর্য উদয় হয়। আলোকিত হয়  মাঝের চর। কুয়াশার চাদর মিশে যেতে থাকে অদৃশ্যে ।আমানের ভাই বোন সকলে মিলে যে যার মত কাজে নেমে যায় ।
ভাই বোনদের মধ্যে সকলেই আমানের ছোট পারু বিবি, রাশিদা বেগম, আম্বিয়া খাতুন, শাহানুর বেগম, রেবু বিবি, কালিমুল্লাহ, আমির হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, আনোয়ার হোসন।
আমান ,কালিমুল্লাহ, জাহাঙ্গীর তিন ভাই মিলে ভাতের থালা ডিস হাতে নিয়ে ছুটে যায় খাল থেকে মাছ ধরার জন্য। জোয়ারের সময় নদীর পানিতে খাল পরিপূর্ণ হয়ে গেলেও ভাটার সময় অল্প পানিতে ছোট ছোট মাছে কিলবিল করে। বাটা , চিংড়ি ,চেউয়া , পুঁটি, বেলে মাছে কিলবিল করে ওই সময় ।
খাল বাঁধ দিয়ে পানিটুকু সিচে ফেললেই হলো অসংখ্য মাছ পাওয়া যায়।
তিন ভাই মিলে খাল বাঁধ দিয়ে অনেকগুলি ছোট ছোট মাছ ধরে  ছোট বোন শাহানুর ,রাশিদা ও আম্বিয়া ওদের কাজে সহযোগিতা করে। খুব আনন্দের সাথে মাছ ধরে তারা । মাছ ধরার সময় ভাই-বোনেরা মিলে আনন্দের সাথে হইচই করে- পাইছিরে বড় একটা পাইছি ওই একটা বড় মাছ এই যে বাইলা মাছ।
ভাই-বোনেরা মিলে অনেকগুলো প্রায় দুই টুকরি মাছ ধরে । কিছু মাছ ওদের মা আরফুজা বেগম রান্না করে বাকিগুলো পলিথিনের উপর বিছিয়ে দিয়ে শুটকি করে।
আম্বিয়া এবং পারু দুই বোন মিলে খাবারের কিছু পাওয়া যায় কিনা চরের মাঝে খুঁজতে থাকে, এক সময় তারা বুনো ধানের ক্ষেতে পেয়ে যায় ।
স্থানীয় ভাষায় এ ধান কে ‘উড়িধান’ বলে। দুই বোন মিলে দুইটি উরি ধানের বোঝা নিয়ে আসে তাদের ছোট্ট কুঠিরে ।
উড়িধান হলো এমন জাতের ধান যা চরাঞ্চলে এমনিতেই জন্মায়। এটি বুনো  তৃণ জাতীয় ধান। এক জাতীয় ঘাসে এ ধান জন্মায়।
এ জাতের ধান পাকার আগেই  ঝরে যায়।  তাই ধান গাছের রাইজোম বা গোড়া থেকে নতুন ধানের জন্ম হয়। উড়িধান দেখতে অনেকটা গমের মত।
উড়িধান দিয়ে খই ভেজে  খাওয়া যায় অথবা ভাতের মত রান্না করে খাওয়া যায়। চরাঞ্চলের অসহায় মানুষজন খাবারের কোন কিছু না পেলে এই উড়ি ধান দিয়েই চলে তাদের জীবন জীবিকা। চরাঞ্চলের হতদরিদ্র লোকজন
সারা বছরের জন্য উড়ি ধান সংগ্রহ করে গোলা ভরে রাখে । কোন খাবার না পেলে এই উড়ি ধান দিয়েই চলে তাদের আহার্য। বৈরী পরিবেশে ,ঝর জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ত পানিতে সফলভাবে জন্মায় উড়িধান ফলনও  ভালো হয়।
অনেক সময় প্রবল জোয়ারের পানিতে ভেসে আসে অসংখ্য উড়ি ধানের গোছা তখন চরাঞ্চলের মানুষ এ ধান সংগ্রহ করে গোলা ভরে রাখে।
ভোলা জেলার চরফ্যাশন এলাকায় এই ধানের নামানুসারে চরের নাম হয়েছে ‘উড়ির চর’।
এভাবে প্রতিদিনই ভাইবোনেরা মিলে মাছ ধরে খাওয়ার পরে থেকে যাওয়া মাছ শুটকি করে এতে অনেক মাছ জমে যায়। আমানের পরিকল্পনা শুটকি মাছগুলো ভোলা শহরে এনে বিক্রি করবে।
প্রায় ১০ থেকে ১২ দিনের জমা করা মাছ। বস্তায় ভরে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকে মাছ ধরা নৌকার অপেক্ষায়। পরিচিত একটি মাছ ধরা নৌকাকে ডাক দেয় ।
মাছ ধরা নৌকাটির মাঝিমাল্লা দ্বার চেপে চেপে চরের কাছে ভিড়ে । আমান লুঙ্গি কোচা দিয়ে হাঁটু জলে নেমে নৌকায় উঠে।মাথায় শুটকির বস্তা মাঝিরা আমানকে নাছির মাঝি ঘাটে এনে নামিয়ে দেয়। আমান মাঝিকে প্রায় দুই কেজি চিংড়ি শুটকি মাছ দেয়। মাছ পেয়ে মাঝি খুশি হয়।
শুটকি মাছের বস্তা মাথায় নিয়ে আমান নাছির মাঝির মেঠো পথ ধরে হাঁটতে থাকে ভোলা শহরের দিকে। আমান শুটকি মাছের বস্তা মাথায় করে কালিনাথ রায়ের বাজার এনে আড়তের মাঝে ফেলে।
আড়তদার ননী বাবু মাছ দেখে মহা খুশি! ‌আড়তদার ননী বাবু বলেন- এত সুন্দর তাজা মাছ কোত্থেকে আনলে গো খোকা ?
আমান হেসে উত্তর দেয় — মাঝেরচর থেকে আনছি বাবু। ননী বাবু তার সহযোগী অনিলকে ডেকে বললেন- যাকগে ওরে মিষ্টিমুখ করা।  আমাগোরে  জিলাপি খাওয়া । আমানের জন্য প্লেটে করে জিলাপি নিয়ে আসে অনিল । ননী বাবু বলেন –সব সময় আমাগরে মাছ দিবা ।
টাকা লাগলে বারাইয়া দিমুনে। দাদন লাগলে নিবানে। টেহা পয়সা দরকার হইলে আমারে কইবা আমি দিমুনে । জাল সুতা  লাগলে বলবা কিনে দিমুনে ।
ফোকলা দাঁতে হেসে উঠে ননি বাবু। তার দাঁতগুলি পান খেতে খেতে কালো রঙ্গের  হয়ে তরমুজের বিচির মত দেখায়। উপর নিচে দুটি করে চারটি দাঁত নেই , কথা বলার সময় মুখ দিয়ে পানের অংশ বের হয়ে আসে। গায়ের রং ফর্সা মাথায় চুল নেই। হেসে হেসে মাথা নেড়ে বিশেষ ভঙ্গিতে কথা বলে। যেন সিনেমার অভিনয়ের শিল্পী।
ননী বাবু বলেন- এই অনিল আমার জন্য এক খিলি পান নিয়ে আয়, হাদা বাড়ায়া দিছ। অনিলের দেয়া জিলাপির প্লেট হাতে ধরা ছিল আমানের। সে হতবাক দৃষ্টিতে ননি বাবুর কথাগুলি শুনছে। তার ভালই লাগছে।
এই শুটকি মাছ বিক্রি করে এত আদর যত্ন পাবে মিষ্টি মধুর কথা শুনবে আমান  ভাবতেই পারেনি।
এক চাকতি জিলাপি হাতে নিয়ে আমান মুখে দিয়ে চিবুতে থাকে ।
আহ কী মজা ! মনে মনে ভাবে ভাই-বোনদের জন্য দুই কেজি কিনে নিয়ে যাব ।
আড়‌তদারের সহযোগী অনিল কাঠের দাড়িপাল্লায় শুঁটকিতে মাছ মেপে বলে বাবু তোমার শুঁটকির ওজন ৪২ কেজি হয়েছে ২ কেজি রয় বাদে চল্লিশ কেজি হইছে দুই টেহা সের দরে ৮০ টেহা মূল্য।
আমান টাকার কথা শুনে মনে মনে খুব খুশি হয়ে যায়।
আড়তদার থেকে ৮০ টাকা হাতে নিয়ে  বারবার টাকা গুলো। গুনতে থাকে। আমান টাকা লুঙ্গির কোচে গুঁজে নিয়ে ভোলা শহরের সদর রোড হয়ে মুদির দোকানে হলুদ ,মরিচ, নুন ,তেল মায়ের বলে দেওয়া সকল নিত্য পণ্য কিনে বস্তায় ভরে।
বোনদের জন্য আলতা চকবাজার থেকে কিছু জাল বানানোর সুতা একটি ঝাকি জাল কিনে সবশেষে নতুন বাজার এসে দুই টাকা দিয়ে দুই কেজি জিলাপি কিনে নাছির মাঝির পথে রওনা দেয়।
আমান হাঁটতে থাকে নাছির মাঝির মেঠো পথে। চরের উদ্দেশ্য নাছির মাঝি বাজারে এসে সদাই বোঝায়  বস্তাটি মাথা থেকে নামিয়ে ।
নাছির মাঝি বাজারের সেকান্তর মিয়ার চায়ের দোকানে ঢুকে এক কাপ চা আর একটি আটার রুটি খেয়ে তৃপ্তির ঠেকুর তুলে আমান।
আবার রওনা হয় চরের উদ্দেশ্য পাতাবুনিয়ার পরেই মেঘনার পাড়। মেঘনার পাড়ে বস্তা বজাই সদায় নিয়ে আমান দাঁড়িয়ে থাকে উপার যাওয়ার উদ্দেশ্য ।
নদী দিয়ে অনেক মাছ ধরার নৌকা এদিক সেদিক যেতে থাকে আমানকে চিনে এমন একজন মাঝিকে সে ডাক দেয় , মাঝি তার ইশারায় সায় দেয় নৌকা নাছির মাঝি ঘাটে ভিরায়।  আমান বলে –  আমারে একটু নামায়া দিবা চরে,
কয়টা টেহা  দিমু ।
মাঝি সম্মতির মাথা নারে আমান খরিতকৃত সদাই বোঝাই পাটের বস্তাটি মাথায় করে নৌকায় তুলে রওনা দেয় মাঝের চরের উদ্দেশ্য ।
একটু পরেই মাঝেরচরে ভিড়লে আমান কোচ থেকে মাঝিকে দের টাকা দেয় এবং সাথে দুই পিজ জিলিপি দেয় ,মাঝি মানকে নামিয়ে দিয়ে হেসে বিদায় নেয় ।আমান বস্তা আবার মাথায় তুলে চড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
আমানের সদাই ভরা বোস্তাটি  দেখে পরিবার সকলে একই সাথে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ।
আমাদের মা আরফুজা বেগম বস্তা খুলে এক এক করে সদাই বের করতে থাকে আর হাসে। জিলাপির প্যাকেটটি খুলতেই সবাই কিলবিল করে একটু একটু করে জিলাপি ভাগ করে খেতে থাকে ।
হইচই হাসির রোল পড়ে যায় হোগলা পাতার কুঠিরে। আমানের মা তার ছেলের বুদ্ধি দেখে হতবাক হয়ে যায় খুশি হয়। আমানের বাবা একটু দূর থেকে সবকিছু দেখে আর মুচকি হাসে ,এই হাসি যেন মুক্ত হয়ে ঝরে ।
আমানের বাবা আলী আহাম্মদ মাল ঝাকি জাল  পেয়ে খুবই খুশি হয়। সাথে সাথে জালটি নিয়ে সাথে একটি পাটের বস্তা নিয়ে মাছ ধরার জন্য খালের দিকে রওনা দেয় ।
খালের মধ্যে জাল ফেলে ফেলে সে অনেকগুলো বাটা ,চিংড়ি ,দেউয়া , পুঁটি মাছ ধরে আনে । ভাটার সময় ছোট ছোট মাছ গুলো খালের মধ্যে কিলবিল করে। অল্প পানির মধ্যে যখন বড় বড় বাটা মাছ বড় ভাসা ভাসা চোখে কিলবিল করে তখন দেখতে চশমাপরা ভদ্রলোকের মত মনে হয়।
তাদের শুটকি করার যে পদ্ধতি তার আরো প্রসার করে বাড়তে থাকে তাদের ব্যবসায়িক মানসিকতা।
পরদিন সকালে আমানের বাবা জাল দিয়ে অনেকগুলি বেলে , চিংড়ি , চেউয়া  সরপুটি ধরে আনে।
আমানের ভাই বোনেরা মিলে ঘরের কাছে ছোট্ট একটি কুয়োর তৈরি করে , কুয়োতে পানি দিয়ে তাদের ধরা মাছ জীবন্ত মাছ রাখে পরদিন আমান  নাছির মাঝি বাজারে নিয়ে আসে ভালো দামে বিক্রি করে ।
বিক্রি করে ফিরতি নৌকায় আমান মাঝের চরে চলে যায় ।তাদের এখন একটি স্বপ্ন  ছোট্ট নৌকা তৈরি করা যাতে তারা নিজেরাই এপার থেকে ওপার আসা যাওয়া করতে পারে।
 কিছুদিনের মধ্যে  কাঁচা এবং শুটকি মাছ বিক্রি করে তাদের কাছে নগদ কিছু টাকা আসে।
এই টাকা  দিয়ে তারা ছোট একটি নৌকা কিনে ফেলে। পরিবারের যোগাযোগের একটি সুব্যবস্থা হয়। নৌকাটি তাদের বাড়ির কাছে একটি বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে রাখে । প্রয়োজনে তারা মাছ ধরে এপার ওপারে বিক্রি করে ভালো টাকায় রোজগার করে।
দ্রুত ঘুরতে থাকে তাদের ভাগ্যের চাকা। ভাই-বোনদের জন্য আমান কিনে আনেন নতুন নতুন জামা কাপড় ।
সংসারের সব নিত্য পণ্য ,কৃষি কাজ করার সামগ্রী । এখন তাদের স্বপ্নের পরিধি বাড়তে থাকে ।
তাদের স্বপ্ন গরু কিনবে চাষবাস করবে মাঝের চড়ে ফসল ফলাবে ।
আমান ভোলা শহর থেকে কোদাল কিনে আনেন , সেই কোদাল দিয়ে তার বাবা মাটি কুপিয়ে কুপিয়ে কিছু শাক সবজির চাষ শুরু করে ।
কিছুদিনের মধ্যেই লক লক করে বাড়তে থাকে লাউ, কুমড়া, লাল শাক ,ধনিয়া পাতা আরো নানান জাতের সবজি ।
তারা নিজেরা খেয়ে মাছের সাথে কিছু শাকসবজিও এপারে নিয়ে আসে বিক্রির জন্য বিক্রি করেও ভালো টাকা আয় রোজগার করে আমানের পরিবার ।
কর্ম যে মানুষকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয় , তা এই পরিবারের একটি দৃষ্টান্ত উদাহরণ।
মাছ এবং সবজি বিক্রি করে তাদের আয় রোজগার দিন দিন বাড়তে থাকে একদিন আমানের বাবা কিছু টাকা নিয়ে রওনা হন গরু কিনার জন্য নাছির মাঝি বারেক ব্যাপারীর কাছ থেকে দুইটি বলদ গরু এবং মোল্লা বাড়ি থেকে নাঙল জোয়াল কিনে নিয়ে শুরু হয় তাদের বহুদিনের স্বপ্নের চাষবাস।
আমানের বাবা আলী আহাম্মদ সুতা দিয়ে বিশেষভাবে জাল বুনে লম্বা বাঁশের খুঁটির সাথে বেঁধে জলচর পাখি ধরার ফাঁদ তৈরি করে। এতে রাতের বেলায় জাল টানিয়ে রাখলে বড় বড় বুনো হাঁস , ছোট ছক্কা জালে জড়িয়ে যায়।
প্রতিরাতে শত শত হাঁস ,ছক্কা , বক , জলচর পাখি ধরে খাঁচার মধ্যে বেঁধে রেখে সকাল বেলায় নাছির মাঝি এলাকায় বিক্রি করে ভালো টাকা আয় রোজগার করে।
পলিমাটি দিয়ে তৈরি মাঝের চর ফসল খুব ভালো উৎপন্ন হয়।
কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো বড় বড় ইঁদুর স্থানীয় নাম ‘কডা’ এরা ফসল কেটে ফেলে নষ্ট করে।
রাতের বেলা পাহারা দিয়ে ফসল ফলাতে হয়। শীতের মধ্য রাতে পাহারাদা খুব কষ্টকর।
আমান ভোলা এসে নতুন বাজার ভুট্টু মালের দোকান থেকে অনেকগুলি বিদেশি পুরাতন গরম সুইটার কিনে নেন ।
এক দুই টাকা দামে বিক্রি হতো এসব সুয়েটার গরম কাপড় ।
আমানের পরিবারে কেউ বড় ইদুরের দেখা পেলেই এরা পরিবারের সকলে মিলে যেভাবেই হোক এই ইঁদুর মারতেই হবে ।
গর্তের মধ্যে পানি ঢেলে জোয়ারের সময় ইঁদুর ভেসে উঠলে পিটিয়ে মেরে এদের সংখ্যা কমাতে থাকে ।
আমান এপার থেকে দুটি বিড়াল দুটি কুকুর নৌকায় করে তাদের মাঝেরচরে নিয়ে যায়।
বিড়াল এবং কুকুরেরা মিলে চড়ের ইঁদুর মেরে মেরে সব নিপাত করতে থাকলো। ধীরে ধীরে কমতে থাকলো বড় ইঁদুরের সংখ্যা ।
এতে ফসল ভালো হতে থাকলো আয় রোজগারও ভালো হতো।
দিন দিন আয়ের বিভিন্ন পথ সুগম হয় তাদের পরিবারের কাছে । বাড়তে থাকে আয় রোজগার এবং পরিবর্তন হতে থাকে ঘরবাড়ি।

আরো পড়ুন

Tanvir-Arafat-SP-DC

বরিশালে সাংবাদিক পেটানো সেই ডিসি গ্রেফতার

বাংলাদেশ বাণী ডেস্ক॥ বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক উপ কমিশনার (ডিসি) ‘তিন অপশন’ খ্যাত পুলিশ সুপার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *