শুক্রবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৫

একটি সেতু বদলে দিতে পারে দক্ষিণাঞ্চল-বদলে দিতে পারে বাংলাদেশ

এম জামাল বোরহানউদ্দিন প্রতিনিধি।।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল উন্নয়নের নতুন দিগন্তে পা রাখতে যাচ্ছে—এমন সম্ভাবনা বহুদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। আর সেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ভোলা, দেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপ জেলা। সম্পদে ভরপুর এই ভূমি আজও পুরোপুরি বিকশিত হতে পারেনি কেবল একটি অভাবের কারণে—মজবুত ও স্থায়ী সড়কসংযোগ। যেন অফুরন্ত সম্পদে ভরা ঘরটি রয়েছে, কিন্তু তার দরজাটি এখনো খোলা হয়নি। আর সেই দরজাই খুলে দিতে পারে ভোলা–বরিশাল সেতু।

প্রকৃতির অফুরন্ত দানে গড়া বিস্ময়ভূমি ভোলা

চারদিকে নদীবেষ্টিত ভোলা যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা এক জীবন্ত চিত্রপট। মেঘনা, তেতুলিয়া, বুড়িশ্বরসহ অসংখ্য নদী ভোলাকে তৈরি করেছে প্রাকৃতিক দুর্গের মতো এক দ্বীপে। উর্বর মাটি, বিস্তীর্ণ চরভূমি, সবুজ কৃষিক্ষেত, অপরূপ নদী–সমুদ্রের নাচন, আর বাণিজ্যের জন্য সম্ভাবনাময় নদীপথ—সবই ভোলাকে করেছে দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় জেলাগুলোর একটি।
প্রকৃতি এই দ্বীপকে দিয়েছে অফুরন্ত সম্পদ, কিন্তু সেই সম্পদকে দ্রুত সারা দেশে পৌঁছে দেওয়ার কার্যকর যোগাযোগ নেই বলেই অঞ্চলটি জাতীয় অর্থনীতির মূলস্রোতে পুরোপুরি ঢুকতে পারেনি।

গ্যাসের বিপুল ভাণ্ডার—শিল্পবিপ্লবের পূর্বাভাস

ভোলার গ্যাস সম্পদ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাশা ব্যাপক। এখানে পাওয়া গেছে জাতীয় গ্রেডের উচ্চমানের গ্যাস, যার সম্ভাব্য মজুত ১ ট্রিলিয়ন ঘনফুটেরও বেশি। এই গ্যাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সারের কারখানা,
টেক্সটাইল ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প,
রফতানিমুখী শিল্পাঞ্চল, নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইকোনমিক করিডোর)।
কিন্তু এসব স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম শর্ত ভোলা–বরিশাল সেতু। সেতু হলে গ্যাসভিত্তিক শিল্পকারখানার জন্য প্রয়োজনীয় যাতায়াত, পরিবহন ও লজিস্টিক ব্যবস্থা পুরোপুরি নিশ্চিত হবে।

ইলিশের রাজধানী ভোলা—অর্থনীতির প্রাণ

বাংলাদেশের ইলিশ যদি রানি হয়—তার রাজ্যভূমি ভোলা। দেশের মোট ইলিশের সবচেয়ে বড় অংশ আসে ভোলার নদী ও মোহনা থেকে। প্রায় ৩ থেকে ৪ লাখ পরিবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত এই শিল্পে।
কিন্তু দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থা নেই বলে অনেক সময় ইলিশের মান নষ্ট হয়, খরচ বাড়ে, বাজারজাতকরণে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। সেতু হলে
কোল্ড স্টোরেজ শিল্প, প্রক্রিয়াজাত মৎস্যশিল্প, রফতানি প্রক্রিয়া, ব্র্যান্ডিং ও আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণ সবকিছুই বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য অর্থনীতি পাবে নতুন গতিপ্রবাহ।

চরের ভূমি—কৃষির ‘স্বর্ণভূমি’

নদীর স্রোতে প্রতিনিয়ত নতুন চর তৈরি হয় ভোলায়। এই উর্বর চরগুলোতে উৎপন্ন হয়—
দেশসেরা তরমুজ, চিনাবাদাম, লেবু, মরিচ, সুপারি,
বিভিন্ন মৌসুমি সবজি। দেশের বড় শহরগুলোর সঙ্গে দ্রুত মহাসড়ক যোগাযোগ তৈরি হলে কৃষিপণ্য পরিবহনে সময় কমবে, নষ্ট হওয়া পণ্য বাঁচবে, কৃষকের আয় বাড়বে। এমনকি অনেক পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারেও পৌঁছাতে পারবে সহজেই।

পর্যটনে ভোলার অদম্য সম্ভাবনা

চর কুকরি-মুকরি, মনপুরা, নদী-সাগরের মিলনবিন্দুর অপরূপ সৌন্দর্য, উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন, মনোমুগ্ধকর সূর্যাস্ত—সব মিলিয়ে ভোলা পর্যটনের জন্য এক অমূল্য রত্নভূমি।
তবুও পর্যটনশিল্প গড়ে ওঠেনি ঠিকমতো, কারণ—দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থা।
সেতু হলে ভোলায় গড়ে উঠতে পারে—
অ্যাডভেঞ্চার–ট্যুরিজম, ইকো–ট্যুরিজম, রিসোর্ট শিল্প, কটেজ ইন্ডাস্ট্রি, আন্তর্জাতিক পর্যটন–আকর্ষণ। তখন ভোলা হবে উপকূলীয় পর্যটনের নতুন রাজধানী।

ভোলার মানুষ—সম্ভাবনার চালিকাশক্তি

ভোলার সবচেয়ে বড় শক্তি এর মানুষ। নদীর সঙ্গে লড়াই করে বড় হওয়া এই জনগোষ্ঠী পরিশ্রমী, দৃঢ়চেতা ও উদ্যোমী। কৃষি, নৌ–জীবন, মৎস্যশিল্প—সবক্ষেত্রেই তাদের দক্ষতা ও শ্রম জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। সেতু হলে এই মানবসম্পদই দক্ষিণাঞ্চলকে এগিয়ে নেবে বহুদূর।

তাহলে পিছিয়ে আছে কেন দক্ষিণাঞ্চল?

একটি কারণ—যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা। আজও ফেরির ওপর নির্ভর করতে হয় জীবনের প্রতিটি প্রয়োজনীয় যাতায়াতে। এতে সময় নষ্ট হয়, খরচ বাড়ে, পণ্য নষ্ট হয়, রোগী পরিবহনে ঝুঁকি বাড়ে,
শিল্প বিনিয়োগে আগ্রহ কমে যায়। যেখানে একটি সেতু পুরো অঞ্চলকে ঢেলে সাজাতে পারত, সেখানে সেই সেতুর অভাবে উন্নয়নের পথ আটকে আছে বহু বছর।
ভোলা–বরিশাল সেতু: দক্ষিণাঞ্চলের মুক্তির মহাসড়ক
এই সেতুটি কেবল একটি স্থাপনা নয়; এটি হবে—
গ্যাসভিত্তিক শিল্পের জন্মদাতা,
কৃষি ও মৎস্যপণ্যের আধুনিক বাণিজ্যপথ,
পর্যটনশিল্পের বিপ্লব, শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার,
চিকিৎসাসেবা সহজীকরণ, অন্তত ১০–১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের উৎস, দক্ষিণাঞ্চলের আর্থসামাজিক মুক্তির সোনালি চাবিকাঠি।
এই সেতু নির্মাণ হলে বদলে যাবে প্রায় এক কোটি মানুষের জীবনযাত্রা। অর্থনৈতিক মানচিত্রে দক্ষিণাঞ্চল যুক্ত হবে কেন্দ্রীয় অর্থনীতির সঙ্গে ।আর তখন ভোলা শুধুই একটি জেলা থাকবে না; হয়ে উঠবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার ও উন্নয়নের নতুন অক্ষ।

আরো পড়ুন

বাবুগঞ্জের ইউএনও’র বদলি স্থগিতের দাবিতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে মানববন্ধন

বাবুগঞ্জ প্রতিনিধি।। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার জনপ্রিয়, জনবান্ধব ও মানবিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারুক আহমেদের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *