আহমেদ বেলাল।।
বাংলা সাহিত্যের ভুবনে আহমদ ছফা এক অনন্য নাম। তিনি শুধু একজন লেখক নন, ছিলেন একাধারে চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সমাজতাত্ত্বিক, এবং তরুণদের অভিভাবকতুল্য দিশারী। ২০০১ সালের ২৮জুলাই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান কিন্তু রেখে যান এমন এক সাহিত্যিক ও বৌদ্ধিক উত্তরাধিকার, যা এখনও আমাদের ভাবায়, হৃদয়কে নাড়া দেয়।
তিনি ছিলেন একজন প্রতবাদী ও প্রগতিশীল, স্বাধীনচেতা লেখক। যাকে মীর মোশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম লেখক হিসেবে ধরা হয়। তিনি তাঁর জীবনে অসংখ্য গল্প,উপন্যাস এবং প্রবন্ধ লিখেছেন। আত্মজীবনী লেখার বাসনা ছিল কিন্তু লিখে যেতে পারেননি, তবে ‘সাপ্তাহিক রোববার’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে তার আত্মজীবনীমূলক রচনা প্রকাশের কথা ব্যক্ত করেছিলেন, নামও দিয়েছিলেন- ‘অমৃত সমান’। কিন্তু জীবন তাকে সে অবসর দেয়নি।দূর্ভাগ্যক্রমে আহমদ ছফার আত্মজীবনী আমরা পড়তে পারছি না, তবে লেখক মোহাম্মদ আব্দুর রউফ তাঁর ‘আহমদ ছফা’ নামক বইটিতে লেখকের জীবনের অনেকটা অংশই খুব সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন।
আহমদ ছফার জন্ম ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামে। ছফা’র বাবা অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী মানুষ ছিলেন। তিনি ছেলের সুশিক্ষার সমস্ত বন্দোবস্ত করেন। কোরান পড়া, আরবী -ফার্সী ভাষা শেখা, পাঁচ মিনিটের কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য শোনানোর জন্য ছেলেকে কাঁধে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন। চারিত্রিক ও নৈতিক উন্নয়নের জন্য হিন্দু হোস্টেলে এক হিন্দু শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। ছেলের জন্য এ সব কিছুই তাঁর বাবা করেছিলেন, ফলে প্রাথমিক শিক্ষাটা তিনি বেশ ভালোভাবেই পেয়ে যান। তাই বলে-তিনি ছেলে হিসেবে সুবোধ ছিলেন এমন কিন্তু নয়। মন্দির থেকে যেমন রামায়ণ চুরি করে পড়া, মজা করে খড়ের স্তূপে আগুন লাগিয়ে দেওয়া, তেমনি ছোট শালিক পাখির মৃত্যুতেও তিনি অঝোরে কেঁদেছেন।
মানুষ হিসেবে আহমদ ছফা ছিলেন অনেক বেশি ব্যক্তিত্ত্বসম্পন্ন এবং অভিমানী। অনেক সময় শিক্ষকদের ওপর অভিমান করে তিনি ক্লাস, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছেড়েছেন, কারণ তাঁর মতে শিক্ষকরা ছাত্রদের বকা দিবেন না বরং স্নেহ করবেন; আর এটাই হওয়া উচিৎ বলে তিনি মনে করতেন।বইয়ের প্রতি তার নেশা ছোট থেকেই ছিল। উচ্চমাধ্যমিকের পর ছফা ঢাকায় আসেন শুধুমাত্র লেখক হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই। বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা জমা দিয়েও কোনো আশার মুখ দেখেননি। এমনকি তাকে এমনও বলা হয়েছে যে, তিনি যেন তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলেন, নইলে ঢাকা শহরে আরেকটা লম্পটের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। অবশেষে রণেশ দাশগুপ্তের সহায়তায় ছফা’র বেশ কিছু কবিতা ছাপা হয়। এমনকি তার চাপেই তিনি প্রবন্ধ লেখায় হাত দেন। পরে তিনি বেশকিছু পত্রিকা সম্পাদনাও করেছিলেন- মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং পরে। যদিও যুদ্ধে তার দৈহিক উপস্থিতি ছিল না কিন্তু তার কলম থেমে থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী তার প্রায় সব রচনাই কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত ছিলো।
ছফা শুধু নিজেকে নিয়ে নয় বরং মানুষ কে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁর মতে,”সকলে আমার মধ্যে আছে,আমি সকলের মধ্যে আছি”। তিনি নিজের সাধ্যমত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। পথশিশুদের জন্য স্কুল খুলেছেন, সব ব্যয় নিজেই বহন করতেন। হাতে টাকা এলে কখনো কখনো ছুটে যেতেন ত্রাণ বিতরণ করতে। আবার জামা কাপড় কিনে বিলি করতেন অসহায়দের মধ্যে। কবি ফররুখ আহমেদ পাকিস্তানী আদর্শ নিয়ে কবিতা লিখে যখন সরকারের রোষানলে পড়েন এবং তাঁর এক মেয়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যান তখন আহমদ ছফাই প্রথম মুখ খোলেন, প্রতিবাদ জানান। সলিমুল্লাহ খানের প্রশংসাপত্র সংগ্রহ, তরুণ কবি আবুল হাসানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনঃভর্তি, এস এম সুলতানের নামে ‘শিল্পী সুলতান পাঠশালা’ প্রতিষ্ঠা করেন। ছফা’র পরিজন ছিল না কিন্তু নিয়মিত তিনি তাঁর ভ্রাতিষ্পুত্রদের চিঠি পাঠাতেন, তাদের পড়াশোনার খরচ বহন করতেন, খোঁজ খবর নিতেন। এ সব কিছুই শুধু এক মহান মানুষের পক্ষেই ভাবা সম্ভব।
ব্যক্তিগত জীবনে আহমদ ছফা ছিলেন চিরকুমার কিন্তু বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য, ফলে তিনিও জীবনে বেশ কয়েকবার প্রেমে পড়েছিলেন। তার কিছু শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের মাধ্যমেই আমরা তাঁর প্রেমিকাদের সম্পর্কে জানতে পারি। ইন্দীরা নামের এক হিন্দু নারীর সাথে তাঁর দীর্ঘ ৮ বছরের প্রেম ছিল। দু’জন দুই ধর্মের হওয়ায় সমাজের চোখে তারা অপরাধী ছিলো, এক হতে পারেনি, ফলে নিজেই দায়িত্ব নিয়ে তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। ঘর বাঁধার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন কিন্তু তাঁর হাজারো সীমাবদ্ধতা মেনে নেয়ার মত উদারচেতা নারীর সাক্ষাৎ তিনি কখনো পাননি।
জীবীতাবস্থায় ছফা কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাননি। বাংলা একাডেমি এবং লেখক শিবির পুরস্কার তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। মৃত্যুর পর তাকে একুশে পদক দেয়া হয়। ছফা শক্ত ধাচের মানুষ ছিলেন। তোষামদী বলে কিছু তার স্বভাবে ছিল না। আহমদ ছফা’র সাহিত্যকর্মকে যথাযোগ্য মূল্যায়ন করে তাকে মরণোত্তর পুরস্কার দিয়ে বাংলা একাডেমির উচিৎ লজ্জা এবং অপমান থেকে মুক্তি পাওয়া। জীবীতবস্থায় আহমদ ছফা হয়তো এ ধরনের পুরস্কার কখনো গ্রহণ করতেন না।
ছফা আগে থেকেই একাধিক রোগে জর্জরিত ছিলেন।ধূমপান করতেন নিয়মিত। তাকে কখনো মেডিকেলে নেয়া যেত না। যদিও-বা নেয়া যেত, বদ্ধঘরে তাকে আটকে রাখতে হত নইলে তিনি ছোট বাচ্চাদের মত আচরণ করতেন। বিভিন্ন ছুতো দিয়ে পালিয়ে যেতেন। ২৮ জুলাই, ২০০১ সালের এক বৃষ্টিস্নাত দিনে আহমদ ছফা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। প্রকৃতি যেন সারাদিন তাঁর জন্যই অশ্র বিসর্জন করেছে। জীবনের শেষ দিন অব্দি তার সার্বক্ষণিক সাথী ছিলেন পালক পুত্র ইদ্রিস।
মৃত্যুর আগেই তিনি লিখে গিয়েছেন-
“আমি যখন চলে যাব
আমার খবর হাওয়ার কাছে নিয়ো
বিশদ যদি জানতে চাহ
শিশিরে শুধায়ো”
মৃত্যুবার্ষিকীর এই দিনে বিপ্লবী আহমদ ছফাকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
তথ্যসূত্র:
আহমদ ছফা – মোহাম্মদ আব্দুর রউফ
কালের নায়ক- গাজী তানজিয়া
আহমদ ছফা’র সাহিত্যাদর্শ- সলিমুল্লাহ খান
আহমদ ছফা’র উপন্যাস সমগ্র
আহমদ ছফা’র গল্প সমগ্র
আহমদ ছফা’র প্রবন্ধ সমগ্র

Daily Bangladesh Bani বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দৈনিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের প্রচার করি।
আহমদ ছফা’কে নিয়ে অসাধারণ একটি লেখা! ধন্যবাদ, লেখক আহমেদ বেলালকে।