শুক্রবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৫

বই, মানুষ ও শব্দের এক মহোৎসব

আহমেদ বেলাল ।।
বরিশাল শহরের কেন্দ্রস্থল চৌমাথা সংলগ্ন পার্ক—যেখানে শহরের শ্বাস-প্রশ্বাস, জীবনযাপন আর কোলাহলের সমান্তরালে গড়ে উঠেছে এক নিরালম্ব, অথচ প্রাণবন্ত সাহিত্যিক চৌকাঠ। পার্কের পাশেই ফুটপাতের গা ঘেঁষে সাজানো উন্মুক্ত বইয়ের দোকান, যার চারপাশে বিকেলে জমে ওঠে এক অপূর্ব সাহিত্য আড্ডা—শহরের শিক্ষিত সমাজের আন্তরিক ও মেধাবী অংশের মিলনমেলাও বলা চলে।
গত শুক্রবার ঠিক সন্ধ্যা নামার পরপরই শিল্পের আলো নিয়ে জেগে উঠেছিল উন্মুক্ত বইয়ের প্রাঙ্গণটি। চারপাশে দেয়াল নেই, ছাদ অবশ্য ছিলো; ছিলো বইয়ের সুবাস, চায়ের ধোঁয়া, কবিতার ছন্দ আর কিছু প্রাণবন্ত মুখ। প্রাণবন্ত এই আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন- ‘শুক্রবারের আড্ডা’র দিশারী ও প্রধান আলোচক অমৃত লাল দে কলেজের  অধ্যক্ষ মো: মাহবুবুল হক । বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানিক মিয়া মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মো: মোকলেছুর রহমান, বরিশাল জেলা এনসিপি’র প্রধান সমন্বয়কারী মো: আবু সাঈদ মুসা।
আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রবন্ধকার মাহমুদ ইউসুফ, কবি মৃন্ময় হাসান, কবি আহমেদ বেলাল, কবি সাইফুল্লাহ সাইফ এবং শিক্ষক সোহাগ খান প্রমুখ। সাহিত্য আলোচনার পাশাপাশি কবিতা, গান, ইসলামী সংগীত ও গজলে মুখরিত ছিল চারপাশ। কবিতা আবৃত্তি করেন কবি মৃন্ময় হাসান, গান পরিবেশন করেন কবি আহমেদ বেলাল, ইসলামি সংগীত পরিবেশন করেন কবি সাইফুল্লাহ সাইফ এবং গজলে ছিলেন সাব্বির হোসেন। আগ্রহী শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মো: আব্দুল্লাহ ঈসা, মো: সিফাত খান, মোহাম্মদ সারোয়ার হোসাইন, মো: রেজাউল ইসলাম, মো: মাহবুব ভুঁইয়া এবং নাম না জানা আরও অনেকেই।
এই দোকান যেন শুধুই বই বিক্রির জায়গা নয়; এটি হয়ে উঠেছিল একটি সাহিত্যিক প্রাণকেন্দ্র—যেখানে পাঠক, লেখক, শিল্পী, শিক্ষক, ছাত্র ও পথচলতি কিছু মানুষ একত্রিত হয়েছিল জীবনের টানে। শুধু বই নয়, ভালোবাসা, ভাবনা ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য।
এই বইয়ের দোকানে ছিলো না কোন চকচকে সাজসজ্জা। ছিলো কাঠের পুরনো তাক, কয়েকটা ভাঙ্গাচোরা চৌকি, চেয়ার ও বেঞ্চ আর মাটির গন্ধমাখা বইয়ের স্তূপ—কিন্তু এখানেই খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল জ্ঞানের খাঁটি রত্ন। স্বপ্ন দিয়ে বোনা নতুন ও পুরাতন বিভিন্ন বইয়ের পাণ্ডুলিপি—সব মিলিয়ে যেন এক অনন্য জ্ঞানভাণ্ডার।
শুক্রবারের আড্ডার অন্যতম সংগঠক অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মাহবুবুল হক বলেন,
“আমরা চাইছিলাম এমন এক জায়গা, যেখানে শুধুই পাঠ নয়—চিন্তা, আলোচনা আর সৃজনশীলতা থাকবে। এই উন্মুক্ত বইয়ের দোকানটা আমাদের সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে।”
এই আড্ডার মূল সৌন্দর্য হলো এর অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র। এখানে যেমন প্রবীণ আলোচক তর্কে মেতে ওঠেন, তেমনি সদ্য কলেজ পাস করা তরুণও সাহস করে পড়ে শোনান তার লেখা কবিতা কিংবা প্রবন্ধ। শিক্ষকতা ও পড়াশোনার বাইরে এসেও এখানকার এক একজন  হয়ে ওঠেন পাঠক, চিন্তক এবং শিল্পমনস্ক মানুষ।
এই বইয়ের দোকানের উদ্যোক্তা ও বইপ্রেমী ইউনুস সিকদার  জানান-“বই বিক্রির পাশাপাশি, পাঠক গড়ার জন্যই এ দোকান। এ শহরে পাঠচর্চার অভ্যাস ফিরে আসুক—এটাই আমার স্বপ্ন।”
এছাড়াও এই দোকানটির তত্ত্বাবধানে রয়েছেন- সাব্বির খান ও রাতুল নামের দুইজন যুবক, যারা বই ও সাহিত্য আলোচনা নিয়ে খুবই উৎসুক।
সাহিত্য আর সংস্কৃতির চর্চা তখনই প্রাণ পায়, যখন তা সাধারণ মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে। উন্মুক্ত এই বইয়ের দোকান ঠিক সেটাই করে দেখাচ্ছে—নিয়ম-কানুন ছাড়াই কিভাবে বই আলোচনার মাধ্যমে গড়ে ওঠে এক মানবিক, উষ্ণ সমাজ। যেখানে পাঠ শুধু একা একার কাজ নয়, বরং একসাথে ভাবা, বোঝা, অনুভব করার নামই সাহিত্য আড্ডা।
এই শহরের গলি দিয়ে হাঁটলে কোন একদিন হয়তো আপনার কানে ভেসে আসবে কবিতার এমন লাইন—
একদিন সবাই চলে যাবে, থেকে যাবে এই আড্ডা, এই বইয়ের ঘ্রাণ।
আজকের যুগে যখন পাঠাভ্যাস হারিয়ে যাচ্ছে স্মার্টফোনের স্ক্রলে, তখন চৌমাথার এই নিরহংকার বইয়ের দোকান যেন এক জ্বলজ্বলে আলোর দিশা। এমন সাহিত্য আড্ডা শুধু জ্ঞান বিনিময়েরই নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন—নীরব, কিন্তু দৃঢ়!
চৌমাথার উন্মুক্ত এই বইয়ের দোকান প্রমাণ করছে—পাঠ, আড্ডা আর সাহিত্য কখনোই বিলুপ্ত হয় না, বরং একটু সাহস আর উদ্যোগে তা হয়ে উঠতে পারে সমাজ বদলের অনুপ্রেরণা।
শেষে বলা যায়, বরিশালের চৌমাথায় দাঁড়িয়ে পাঠ ও আলোচনার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস যেন একান্তভাবে আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সাহিত্য শুধু পৃষ্ঠা নয়, তা একটি জীবন্ত সংস্কৃতি, যা বেড়ে ওঠে মানুষের মধ্যে, মানুষের পাশে।

আরো পড়ুন

বাবুগঞ্জের ইউএনও’র বদলি স্থগিতের দাবিতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে মানববন্ধন

বাবুগঞ্জ প্রতিনিধি।। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার জনপ্রিয়, জনবান্ধব ও মানবিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারুক আহমেদের …

One comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *