বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪

প্রাণের আড্ডায় মিলিত হলো বরিশালের কবিকূল

পথিক মোস্তফা॥

প্রাণের আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠা এক সোনালি সন্ধ্যায় মিলিত হলো বরিশালের কবিকূল। দীর্ঘ ১৬ বছরের বঞ্চনার কালো অধ্যায় পেরিয়ে ঝলমলিয়ে উঠলো কবি হৃদয়ের ঝিলিক ঝিলিক রোদ। আমরা মিলেছি আবেগে, আমরা উঠেছি সবেগে সাহিত্যের অনুরাগে। এ যেনো এক বাঁধভাঙা আনন্দের হিল্লোল। পাঠক, এই প্রাণের আবেগী স্রোত শতধারায় বিভিক্ত হয়েও একটি চাওয়ায় এসে পরিণত হলো; তার সবটুকু নিঙড়ে নেয়া রসে সিক্ত হলো কবির প্রাণ, কবিতার ভুবন। আর এই প্রাণের অঙ্গন রাঙা প্রভাত হয়ে ফুটে উঠলো বরিশাল বিভাগীয় বইমেলা-২০২৪ এর উঠোনে। এ যেনো বইয়ের মেলা নয়, এ মেলা বইয়ের স্রষ্টার।

উন্মিলিত প্রাণে ঝিলিক ঝিলিক সাহিত্য ছটায় উদ্ভাসিত হলো বরিশাল বেলস পার্কের বইমেলা প্রাঙ্গণ। দেড় দশক, সাহিত্য নয়, যেনো এক ঘরে রাজনীতির দেয়ালে সেঁটে থাকা ব্যক্তিগত সাদাকালো পোস্টারে পরিণত হয়েছিলো কবিতার জগত, আর কবি-সাহিত্যিক হয়ে পড়েছিলেন সেই ঘরের একনিষ্ঠ গোলাম; হয়তো স্বেচ্ছায়; হয়তো বাধ্য হয়ে। রাজ্যহীন হয়ে পড়েছিলো সাহিত্যের সকল রাজন্য। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যেই আগল ভেঙে নতুন কাব্যরাজ্য পত্তন হলো সেই রাজ্যে সবাই রাজা। এখানে কেউ কাউকে প্রজা করে রাখেনি। ঝলমলিয়ে ওঠা এই সাহিত্যের আলোয় দ্যুতিময় হয়ে উঠছে চতুর্দিক। আর তারই একটুকরো আলো ঠিকরে পড়েছিলো বরিশাল বিভাগীয় বইমেলার ‘সাহিত্য আড্ডা’য়। কবি-সাহিত্য-সাংবাদিক-সংগঠক সকলেই এক বৈষম্যহীন সমাজগড়ার প্রত্যয়ে মিলিত হলো প্রাণের আবেগে। এই উচ্ছ্বাস যাকে ঘিরে তিনিও একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক; তিনিও একজন ছোটো গল্পকার, ঔপন্যাসিক, কলামিস্ট। এক প্রাণবন্ত বিনয়ী মানুষ, আফসানা বেগম, তিনি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক। অফিসিয়্যাল পরিচয় ছাপিয়ে তিনি মিলে গেলেন কবির প্রাণে, কবিতার বৈঠকে। সে এক অভূতপূর্ব উৎসবের আলো বিচ্ছুরিত সন্ধ্যার বইমেলা মাঠ। তিনি হয়ে উঠলেন, সকল কবি-সাহিত্যিকের একান্ত শ্রদ্ধার, ভালোবাসার সজ্জন। সকল কবি-সাহিত্যিকের আপনার জনকে পেয়ে সবাই যেমন আনন্দ লাভ করেছে, তেমনি আফসানা বেগমও হলেন আপ্লুত। তিনি বললেন, এমন শীতোষ্ণ সমাদর পাবেন এমনটি তিনি কখনো ভাবেননি। কল্পনার চেয়ে বেশি হৃদয়ের স্পন্দন পেয়েছেন বলে তিনি বরিশালের কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি জানান উষ্ণ শুভেচ্ছা। এই সন্ধ্যা তার জীবনের স্মরণীয়তম হয়ে থাকবে বলে উচ্ছ্বাস জানান তিনি। এই উষ্ণতা তাকে ভবিষ্যতে আরো গোছানো সুন্দর বইমেলা উপহার দেয়ার প্রেরণা যোগাবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, কবি-সাহিত্যিকদের সাথে এই আড্ডাই তাকে বারবার বরিশালে টেনে আনবে।

তিনি দায়িত্বে থাকলে, বৈষম্য ছাপিয়ে বইমেলার এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবেন বলে জানান। বরিশালের কবিদের আত্মার উদ্যম সকলের চেয়ে আলাদা বলে জানান তিনি। কবি-সাহিত্যিকদের সহায়তায় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে গণমানুষের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চেষ্টা করবেন বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বিভাগীয় বইমেলার সান্ধ্যকালীন এই আড্ডায় মিলিত হন বরিশালের ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য সংগঠন ‘শেকড় সাহিত্য সংসদ’ ও জাতীয় কবিতা পরিষদ বরিশাল জেলা শাখার কবি- সাহিত্যিকবৃন্দ। শেকড় সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি সকলকে
সুস্থধারার বৈষম্যহীন সাহিত্য জগতে স্বাগত জানাই। বললাম, দেড় দশকে মুক্তমনে সাহিত্য চর্চা করতে না পারার কথা; কষ্টকথায় ফুটে উঠলো সাহিত্য পত্রিকা ‘শেকড়’ ও ‘প্রভা’ প্রকাশের জন্য গোয়েন্দা দফতরে কৈফিয়ত তলব করার কথাও। তবুও আমরা মিলতে চাই সাহিত্যের প্রাণে, মুক্ত মনে। শিগগিরই একটি কবিতা উৎসব করার কথাও জানালাম প্রাণের আবেগে।

‘শেকড়’ কিংবা ‘কবিতা পরিষদ’র গন্ডিতে আমরা বন্দি নই, আমরা কবি-সাহিত্যিক, এই পরিচয়ে স্বাধীন-সত্য প্রকাশের প্রত্যয়ও ব্যক্ত করলাম। বরিশালের বিশিষ্ট সাহিত্য সংগঠক, প্রিয় সাহিত্য পত্রিকা ‘মুক্তবুলি’র প্রকাশক- সম্পাদক আযাদ আলাউদ্দীন বললেন, আমরা এতোদিন মুক্ত মনে সাহিত্যচর্চা করতে পারিনি, এখন আমাদের সুস্থধারার সাহিত্য নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। ছাত্র- জনতার বিপ্লব যেনো কোনো কারণে ব্যাহত না হয়, তার জন্য কবি-সাহিত্যিকদেরকেও সচেতন থাকতে হবে। কোনো ভাবেই আবার বৈষম্যের রাজনীতি ও ফ্যাসিবাদকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না বলে তিনি দৃঢ় মনোভাব প্রকাশ করেন। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়ে নানান বন্ধুরতার মধ্যেও সাহিত্য ম্যাগাজিন মুক্তবুলি লেখক তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)-এর জেলা আহ্বায়ক শাহনেওয়াজ সাব্বির সাগর বলেন, সংস্কৃতিসেবীরা কখনো অপরাজনীতির দোসর হতে পারে না। দীর্ঘ দেড় দশক শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশি চেতনার মূলধারার কবি-সাহিত্যিকগণ। বিগত সময়ে সাহিত্যের নাম করে ফ্যাসিবাদী শোষককে সমর্থন করা হয়েছিলো। কবি- সাহিত্যিকগণও শুধু এক ব্যক্তি ও একঘরাণার বন্দনায় লিপ্ত ছিলেন। তিনি বলেন, শিল্প- সাহিত্য চর্চার জন্য যে মুক্ত আকাশ দরকার তা আমরা তৈরি করতে চাই। সেজন্য তিনি বাংলাদেশি চেতনায় উদ্বুদ্ধ সুস্থধারার সকল কবি-সাহিত্যিকদের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি বরিশালের কবি-সাহিত্যিকদের পক্ষ থেকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক আফসানা বেগমকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন; এমন একটি প্রাণবন্ত আয়োজনের জন্য। জাতীয় কবিতা পরিষদ, বরিশাল জেলার সভাপতি ও কবি মুস্তফা হাবীব তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, এতদিন আমরা বৈষম্যের শিকার হয়েছি। বরিশালের সকল কবি-সাহিত্যিক একত্রিত হয়ে আমরা আবার সুস্থধারার সাহিত্য চর্চার পরিবেশ তৈরি করবো বলে, মত দেন কবি মুস্তফা হাবীব। তিনি বাংলাদেশের প্রবীণ প্রথিতযশা কবিদের সাথে তার স্মৃতিচারণও  করেন। তিনি বলেন, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বর্তমান পরিচালক বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণেরই ফসল। তাই তিনি কবি-সাহিত্যিকদের যথাসাধ্য সুবিধা প্রদান করবেন বলে আশা করেন কবি।

আড্ডা প্রাণবন্ত করে তোলেন, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বরিশাল জেলার সাধারণ সম্পাদক, কবি জামান মনির, কবি মাহবুব রহমান, কবি আরিফা ইয়াসমিন অজান্তা, কবি জিল্লুর রহমান, কবি আবিদা সুলতানা, কবি কাজী ইশতিয়াক, কবি নুসরাত জাহান, স. ম. জসিম, কবি শাহনাজ পারভীন, কবি মাহমুদা খানম, কবি নুরুল আলম বখতিয়ার, শেকড় সাহিত্য সংসদের সদস্য কবি সজীব তাওহিদ, গবেষক মাহমুদ ইউসুফ, কবি পার্থ রায়, বাচিক ও কণ্ঠ শিল্পী মৌমিতা বিনতে মিজান, মুক্তবুলি ম্যাগাজিন’র নির্ব‍াহী সম্পাদক মোশাররফ মুন্না, সাহিত্য বাজার পত্রিকার সম্পাদক আরিফ আহমেদ প্রমুখ। আড্ডার শেষের দিকে আসেন কবিতার ফেরিওয়ালা মুসাফির শহিদুল ইসলাম, তিনি বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার কবিতা পাঠ করে সকলের মধ্যে আনন্দ প্রদান করেন এবং মুগ্ধতা ছড়ান। আড্ডায় আমরা প্রিয় আপা আফসানা বেগমকে নিজেদের লেখা বিভিন্ন বই ও সম্পাদিত পত্রিকা উপহার দিলাম।

আরো পড়ুন

হিজলায় মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ছাত্রদলের মানববন্ধন

কাজল দে, হিজলা প্রতিনিধি ‍॥ বরিশালের হিজলা উপজেলায় আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ছাত্রদল মানববন্ধন কর্মসূচী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *