শনিবার, এপ্রিল ১২, ২০২৫

ভোলা জেলার উন্নয়নের রূপকার নাজিউর রহমান মঞ্জু

এম. আমীরুল হক পারভেজ চৌধুরী ।।

মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপির) প্রতিষ্ঠাতা নাজিউর রহান মঞ্জুর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী ০৬ এপ্রিল। ২০০৮ সালের এই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন। ১৯৪৮ সালে ১৫ মার্চ ভোলা জেলার উত্তর দিঘলদী ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামের মিয়া বাড়িতে তার জন্ম; পিতা ছিলেন মরহুম বজলুর রহমান মিয়া। ৪ ভাই এর মধ্যে তিনি ২য়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে এম.কম পাস করেন।

প্রথম জীবনে তিনি এশিয়াটিক ট্রাভেলের সাথে জড়িত ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মাস সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদের সদস্য ও হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের ১৮ দফা বাস্তবায়ন পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। জাতীয় পার্টি (জাপা)’র মহাসচিবের দায়িত্বও পালন করেন। চারদলীয় ঐক্য জোটের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) শরীক দল ছিলেন। তাছাড়াও ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পূর্বে নাম ছিল ঢাকা মিনিসিপাল কর্পোরেশন তা পরিবর্তন করে তার নাম দেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। তিনি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দেন।

শিক্ষা এবং সামাজিক উন্নয়ন, মানব সেবা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ছিল নাজিউর রহমান মঞ্জুর ব্রত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি যেমন সুপরিচিত ঠিক তেমনিভাবে ভোলায় জনমানুষের কাছে ভোলার প্রাণপুরুষ ভোলাবন্ধু হিসেবে পরিচিত। ভোলা থেকে চরফ্যাশন সড়কের করুণ বেহাল চিত্র পরিবর্তন করে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন নাজিউর রহমান। গণতন্ত্র ও জাতীয় উন্নয়নে তার অবদান চিরস্মরণীয়। তিনি একজন উদার হৃদয়ের অত্যন্ত পরোপকারী, বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও বড় মানের মহৎ রাজনীতিবিদ ছিলেন। সফল পিতা হিসেবে তিনি তার তিন ছেলেকে বারএট ‘ল’ ডিগ্রি সম্পন্ন করিয়েছেন। তাঁরই বড় সন্তান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) পরিচালিত হচ্ছে।

২০০৭ সালের সিডর উত্তর ভোলার অন্যান্য স্থানের মতো বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাসাননগর ইউনিয়নে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ত্রাণ বিতরণ করার জন্য তিনি ছুটে আসেন। ত্রাণ বিতরণ শেষে ঐদিন নাজিউর রহমান মঞ্জু আমাদের বর্তমান নতুন বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজে এসেছিলেন। তাঁর ছোট ছেলে ব্যারিস্টার ওয়াছিকুর রহমান অঞ্জনসহ ভোলার বিজেপি নেতৃস্থানীয়রাও সঙ্গে ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতা সত্বেও স্থানীয় মানুষের নিবিড় ভালোবাসায় সাড়া দিয়েছেন তিনি।

দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি ভোলার মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্যানিটেশন, টিউবঅয়েলে পানির ব্যবস্থা গ্রহণে তার অবদান অনস্বীকার্য। একটা সময় ভোলায় প্রবাদ ছিল, বাড়ি বাড়ি টিউবঅয়েল মানে নাজিউরের নাম। ভোলায় যখন বিশুদ্ধ খাবারের পানির অভাব, তখন তিনি গভীর নলকূপের ব্যবস্থা গ্রহণ করে পানিবাহিত রোগ নির্মূলে সচেষ্ট ছিলেন। ভোলার চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি ভোলায় এক বছরে সারা বাংলাদেশের মোট বরাদ্দের অর্ধেক অর্থাৎ সাত হাজার নলকূপ প্রদান করেন। যার গ্রাহকদের টাকা নিজেই পরিশোধ করে ফ্রি টিউবঅয়েল বিতরণ করেন। ভোলায় শতাধিক স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল, মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, পার্ক ইত্যাদি স্থাপনে তার অবদান রয়েছে। ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও উত্তোলনে, নদী ভাঙ্গন রোধ, বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদী ভাঙ্গন রোধে তুলাতুলি বাজারে ব্লক স্থাপন, ইরিগেশন প্লান্ট গ্রহণ ও বাস্তবায়নে, খেয়াঘাটের আমূল পরিবর্তন, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল বাস টার্মিনাল নির্মাণ, টাউন হলের আধুনিকায়ন ও জাতীয় মঙ্গলের কবি মোজাম্মেল হকের নামে নামকরণ, সার্কিট হাউজ নির্মাণ, ডিসি অফিস নির্মাণ, জেলা জজ ও দায়রা জজ আদালত ভবন নির্মাণ, এলজিইডি ভবন নির্মাণ, সাতটি উপজেলায় সাতটি ডাকবাংলো, সাতটি হ্যালিপোর্ট, সাতটি উপজেলা পরিষদ গঠনসহ সর্বোপরি ভোলাকে জেলায় রূপান্তরে নাজিউর রহমান মঞ্জুর অবদান অনস্বীকার্য। জেলা সাব-রেজিষ্ট্রার অফিস নির্মাণের জন্য ভূমি মালিকদের নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ প্রদান করে নির্মাণ কাজ ত্বরান্বিত করেন। তাঁর চিন্তা ও চেতনা ছিল ভোলাকে সিঙ্গাপুরের আদলে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী পর্যায়ে গড়ে তোলা।

ভোলায় একটি আধুনিক হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, একটি সি-পোর্ট, সার কারখানাসমৃদ্ধ স্বয়ংসম্পূর্ণ ভোলা গড়ে তোলা জরুরি। ভোলার গ্যাসের যথাযথ ব্যবহার ও স্থানীয় পর্যটন এলাকাগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরে উন্নয়নের মূল স্রোত ধারায় নিয়ে আসা উচিত। তাঁর ইন্তেকালে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে রাজনীতিবিদগণ গণতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে দেশ-জাতির উন্নয়নে কাজ করে যাবেন। তাঁর ইন্তেকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘দ্বীপ’-এর আহ্বায়ক হিসেবে আমি ও আমরা শোক প্রস্তাবসহ তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য একটি বৃত্তির প্রকল্প গ্রহণে দাবি উঠলেও আজও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।

ভোলার মানুষ এই মহান নেতাকে শ্রদ্ধার সাথে হৃদয়ে লালন করে আসছেন। তিনি যেমন ভোলার মানুষকে ভালোবাসতেন তেমনি ভোলার মানুষ তাকে কতটা ভালোবাসে তা বলার অপেক্ষা রাখে না আজও। তিনি আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর উন্নয়নের এক অনন্য র্কীতি। তাঁর এই র্কীতি ভুলার নয়। তার কর্মময় জীবন বাংলাদেশসহ ভোলার মানুষের হৃদয়ে চির জাগরুক হয়ে থাকবে।

এম. আমীরুল হক পারভেজ চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং পিএইচ.ডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরো পড়ুন

বহিষ্কার হলেন বরিশাল নগর গোয়েন্দা পুলিশের এএসআই আউয়াল

নিজস্ব প্রতিবেদক ।। নির্ধারিত এলাকার বাইরে গৌরনদীতে অভিযান চালিয়ে মাদকসহ নারী ব্যবসায়ীকে আটকের পর ছেড়ে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *