শুক্রবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৫

বিএম কলেজে সাহিত্য আন্দোলনঃ চিরহরিৎ এর প্রতিষ্ঠা

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী

১৯৯৮ সাল। জীবনের এক নতুন অধ্যায়ে পা রাখার উত্তেজনা আর স্বপ্নে বিভোর আমরা কয়েকজন তরুণ তখন সদ্য ভর্তি হয়েছি বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ও মর্যাদাপূর্ণ সরকারি বিএম কলেজে—যাকে বলা হয় ‘বাংলার অক্সফোর্ড’। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের যেন মিলনমেলা হয়ে উঠেছিল এই কলেজ চত্বর।

আমার সেই কলেজ জীবনের অন্যতম স্মরণীয় অংশীদার ছিলেন মোঃ নাসির উদ্দীন—এক বন্ধুত্ব, আত্মত্যাগ ও স্বপ্নভাগিত্বের নাম। আমাদের দুইজনের উদ্যোগেই কলেজে প্রতিষ্ঠা হয় একটি সাহিত্য সংগঠন: “সৈকত সাহিত্য সেবা পরিষদ”। আমি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আর নাসির ছিল সম্পাদক। আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম সাহিত্যচর্চাকে সাধারণ ছাত্র সমাজের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলার, সংস্কৃতির আলো ছড়িয়ে দেওয়ার।

সেই সময় আমাদের সঙ্গে বিএম কলেজে ভর্তি হয়েছিল আরও কয়েকজন পরিচিত মুখ: মাহবুব মাস্টারের ছেলে বাবলু (সমাজকল্যাণ বিভাগ), বাড়ৈবাড়ির সোনালী (সম্ভবত অর্থনীতি বিভাগে), এবং আমি নিজে প্রথমে বাংলা বিভাগে, পরে ইংরেজিতে সাবজেক্ট পরিবর্তন করি।

আমার কলেজে ভর্তির অভিজ্ঞতা ছিল যেমন গর্বের, তেমনই বেদনাদায়ক। ভর্তি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় আমি শীর্ষস্থানীয় ছিলাম, বিশেষ করে বাংলা বিষয়ে পেয়েছিলাম ২০-এর মধ্যে ১৮। কিন্তু ভাইভা বোর্ডের এক শিক্ষকের আক্রোশের শিকার হয়ে ইংরেজিতে মনোনয়ন না পেয়ে বাংলাতে ভর্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। স্যার আমাদের পারিবারিক পরিচিত ছিলেন বলেই হয়তো এই অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত। তবে আমি হার মানিনি।

আমি বলেছিলাম, “স্যার, মেধার ভিত্তিতে আমি ইংরেজি পাবো। আমাকে ইংরেজিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দিন। আমি ইংরেজি ছাড়া পড়ব না। নইলে দোয়া করবেন যেন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারি।” এমন স্পষ্ট উচ্চারণে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন উপস্থিত শিক্ষকরা।

সাহিত্য চর্চার অগ্রদূত: ‘চিরহরিৎ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাঃ

এই সংকটময় সময়েও বন্ধুত্ব আর স্বপ্ন ছিল আমাদের পথের পাথেয়। বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও আমি নিয়মিত ক্লাস করতাম ইংরেজি বিভাগে। সে সময় বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডঃ হেমায়েত উদ্দীন আহমেদ স্যারের সহানুভূতির জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তাঁর মৌখিক অনুমতি নিয়েই আমি ইংরেজি বিভাগে ক্লাস শুরু করি।

আমার সহপাঠী ছিলেন মাহবুব, বাশার, সৈকত, লাবণ্য, বন্যা, উম্মে হাবিবা ও রিপা। তাঁদের সকলের সঙ্গেই গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক—যদিও এখন তারা কে কোথায় আছেন, জানি না। তবে স্মৃতির পাতায় এখনও স্পষ্ট তাদের হাসিমাখা মুখ।

সেই সময় আমাদের সাহিত্য সংগঠনের অধীনে একটি সাহিত্যমূলক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই আমি ও নাসির। সেই পত্রিকার নাম ছিল “চিরহরিৎ”। এটি ছিল একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা, যার উদ্দেশ্য ছিল কলেজের সাহিত্যপ্রেমীদের একটি সৃজনশীল প্ল্যাটফর্ম দেওয়া। সীমিত সম্পদ, সীমিত যোগাযোগ আর অগণিত প্রতিবন্ধকতা সত্যেও কয়েকটি সংখ্যা আমরা প্রকাশ করতে পেরেছিলাম। এই পত্রিকাটি একসময় বিএম কলেজের অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই হয়ে উঠেছিল পরিচিত একটি নাম।

চিরহরিৎ প্রকাশনা ছিল নাসিরের ভালোবাসার জায়গা। আমি যখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ধাপের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কুষ্টিয়ার দিকে যাত্রা করি, তখন সম্পাদনার দায়িত্ব পুরোপুরি তুলে দিই নাসিরের হাতে। এবং সে দায়িত্ব সে নিষ্ঠার সাথেই পালন করেছিল। তবে নিয়তির নির্মম পরিহাস, অকালে আমাদের ছেড়ে চলে যায় এই প্রাণোচ্ছ্বল যুবকটি। আজো মনে পড়ে তার সেই হাসিমুখ, সাহসী কণ্ঠ এবং অফুরান স্বপ্নের কথা। তার মৃত্যু আমার হৃদয়ে যে দাগ কেটেছে, তা আজও মুছে যায়নি। আল্লাহ যেন নাসিরকে ক্ষমা করেন, জান্নাত দান করেন—এই দোয়া করি প্রতিনিয়ত।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালে দেখি, আমাদের সেই বন্ধুবলয়ের অনেকেই আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। আজাদ আলাউদ্দীন এখন একটি জাতীয় দৈনিক নয়া দিগন্তের বরিশাল ব্যুরোচিফ এবং বরিশালের আঞ্চলিক পত্রিকা বাংলাদেশ বাণী পত্রিকার সম্পাদক। নার্সিং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে কাজ করছেন মুন্সী এনাম—শিহরণ একাডেমি ও জমজম নার্সিং কলেজের সাথে। তাঁদের সাফল্যে আমি যেমন আনন্দিত, তেমনি নাসিরের অনুপস্থিতি আজীবন এক অতৃপ্তির রেখা হয়ে থেকে যাবে।

জীবনের পথে অনেক কিছুই বদলায়। কিন্তু কিছু স্মৃতি থাকে চিরহরিৎ, কিছু সম্পর্ক রয়ে যায় চিরস্মরণীয়। বিএম কলেজে কাটানো সেই দিনগুলো, ‘সৈকত সাহিত্য সেবা পরিষদ’-এর দিনরাত্রি, আর ‘চিরহরিৎ’ পত্রিকার পৃষ্ঠা উল্টে যাওয়ার শব্দ আজো আমার অন্তর্গত এক সুর হয়ে বেজে চলে। সেই সুরে আছে বন্ধুত্বের উষ্ণতা, সাহসিকতার অনুপ্রেরণা, আর কিছু না ফেরার কষ্ট।

স্মৃতির স্মরণীতে হাঁটতে হাঁটতে আজও মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়াই—যেন দেখি এক তরুণ, বই হাতে, স্বপ্ন চোখে, এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের পথে। তার নাম নাসির। আর তার পাশে, আরেক তরুণ আমি—সেই পুরোনো দিনের মতোই সাহিত্য আর সত্যের সাধনায় অটল।

লেখকঃ সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা।।

আরো পড়ুন

বাবুগঞ্জের ইউএনও’র বদলি স্থগিতের দাবিতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে মানববন্ধন

বাবুগঞ্জ প্রতিনিধি।। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার জনপ্রিয়, জনবান্ধব ও মানবিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারুক আহমেদের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *