বুলবুল আহমেদ, রাজাপুর প্রতিনিধিঃ
গত ৫ জুন সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। ওই দিনই রায় প্রত্যাখ্যান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন শিক্ষার্থীরা।আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লাগাতর কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশব্যাপী প্রতিরোধ, সহিংসতা, সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনা ঘটে।শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার ৬ নং মঠবাড়ী ইউনিয়নের বাদুরতলা গ্রামের সন্তান মোঃ সোহাগ মাহামুদ শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে অংশগ্রহন করে। তখন পুলিশের গুলিতে চোখ সহ শরীরের একাধিক স্থানে গুলিবদ্ধ হন। জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণের গল্প দৈনিক বাংলাদেশ বানী কে সোহাগ মাহমুদ বলেন–
১৮ই জুলাই ২০২৪ইং রোজ বৃহস্পতিবার ছিল অবৈধ স্বৈরশাসককে বিতাড়িত করার জন্য সারা বাংলাদেশে কমপ্লিট শাটডাউনের দিনl বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যা পরবর্তীতে স্বৈরশাসক বিতাড়িত আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় l উক্ত আন্দোলনের শুরু থেকেই দলের হাই কমান্ডের নির্দেশে মাঠে ছিলাম l ১৮ই জুলাই ২০২৪ইং তারিখে আমাদের অবস্থান ছিল উত্তরার রাজলক্ষীতেl সকাল থেকেই সাধারণ ছাত্র ও সাধারণ জনগণের সাথে আমরা বিএনপির নেতাকর্মীরা রাজলক্ষ্মীর পশ্চিম পার্শ্বের গলির সন্মুখে অবস্থান নেই l
পূর্ব পাশেও একই অবস্থা কিন্তু মেইন রোড ছিল পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যদের দখলেl প্রতিদিনের চেয়ে আজকের সকালটা ছিল অন্যরকমের l প্রশাসনের আক্রমণের ধরন দেখে বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল এরা কি স্বাধীন বাংলাদেশের কোন বাহিনী নাকি ভিন দেশীl তাদের আক্রমণের ধরন টা ছিল হিট টু কিল ফর্মুলায় যা ফ্রী ফায়ার গেমস কেও হার মানাবেl অন্যান্য দিন আন্দোলনে রাবার বুলেট, টিয়ার সেল ও কাদানি গ্যাস দিয়ে আক্রমণ করতl আজকে এগুলোর চেয়ে অরিজিনাল বুলেট বেশি ব্যবহার হচ্ছেl
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চোখের সামনে দেশের জন্য ঝরে গেল অনেকগুলো তাজা প্রাণl আহতদের সংখ্যা আর নাইবা বলি কারণ সহযোদ্ধাদের মৃত্যু দেখে আহতের ব্যথা একটুও হৃদয় ছুঁইনিl যার সামনে পড়েছে সেই আহতদের পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে নিয়ে গেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ফ্রি সেবা দিয়েছেl হাসপাতালে নেবার পথে সোনার ছেলে দাবি করা জাতীয় কুলাঙ্গার ভিনদেশি গোলামের অনুসারী যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আহত এবং সাহায্যকারীকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে জটিকা আক্রমণ করে পথিমধ্যে অনেক সহযোদ্ধা ভাইকে আহত/নিহত করেছেন l ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার মধ্য দিয়ে কখন যে দুপুর হয়ে গেল টের পাচ্ছিলাম না তখন ঘড়ির কাঁটায় ১:১৫ মিনিটl
আমাদের ত্রিমুখী ধাওয়ায় রক্ত চক্ষুবাহিনী উত্তরা পূর্ব থানার মধ্যে ঢুকতে বাধ্য হয়l রক্তচক্ষু বাহিনী থানার ভিতরে ঢুকে গেট লাগিয়ে থানার প্রাচীরের উপর থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে আমি তখন একদম সামনের সারিতেl হঠাৎ অনুভব করলাম আমার শরীরের সম্মুখভাগে বেল্টের উপর থেকে মাথা পর্যন্ত কি যেন অনেকগুলো আঘাত করেছেl নিমেষের মধ্যে ঝর্ণার মত শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে তাজা রক্ত শিরশির করে বের হচ্ছেl সবচেয়ে বেশি আঘাতটা অনুভব হলো বাম চোখেl বাম চোখ চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়লাম, নিমেষের মধ্যেই পরিহিত টি-শার্ট, প্যান্ট ও কেডস তাদের নিজস্ব রং পরিবর্তন করে লাল হয়ে গেলl অপরিচিত মুক্তিকামি সহযোদ্ধারা আমাকে নিয়ে উত্তরা উইমেন্স মেডিকেল কলেজে হসপিটালে গেলেনl পথিমধ্যে রক্তাক্ত হাতে পরিচিত সহযোদ্ধাদের জানালে তড়িৎ গতিতে তারও হাসপাতালে এসে হাজির হনl হাসপাতালের
এমার্জেন্সি ডাক্তার এমার্জেন্সি সেবা দেন এবং অবহিত করেন পেশেন্টের চোখের অবস্থা খুবই খারাপ তাকে খুব দ্রুত জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নিয়ে যানl পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে অনেক চেষ্টা করেও কোন অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছিল নাl পরিশেষে নিকট আত্মীয় এক অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীর এর এম্বুলেন্সে করে আমাকে নেয়া হলো জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটেl তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছেl হাসপাতলে প্রিয় নেতা, প্রিয় অভিভাবক বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব জনাব হাবিবুন নবী খান সোহেল ভাইয়ের নির্দেশনা ডা: সোহেল (সাবেক- আহ্বায়ক, ছাত্রদল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখা) সাহেবের তত্ত্বাবধানে তাৎক্ষণিক চোখের প্রাথমিক সার্জারি হয়l
কর্তব্যরত ডাক্তারের ভাষ্য মতে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হসপিটাল এই একদিনেই গান শর্ট ইনজুরির রোগী এসেছে ৫০০ শতর অধিকl ডঃ সোহেল সাহেবের কল্যানেই সিরিয়াল ব্যতীত সার্জারি এবং ভর্তি কপালে জুটে ছিল l হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে ২৪ তারিখ ডিসচার্জ দেনl হাসপাতাল থেকে সরাসরি বাসায় আসতে চাইলে নিকটতম আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব ও রাজনৈতিক অভিভাবক ও সহযোদ্ধারা জানান এ অবস্থাতে কোনভাবে বাসায় থাকা যাবে নাl কারণ আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন তাদেরকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজন ও প্রশাসন বাসায় বাসায় খুঁজে বেড়াচ্ছেl সকলের কথা অমান্য করার সাহস আমার হলো না কারণ পরিস্থিতি কোনো ভাবেই মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে ছিল না সেটা আমি স্পষ্টl
শুরু করলাম ফেরারি জীবন এবং ভাবলাম যে কোন মূল্যে আমাকে মহান রবের ইচ্ছায় পরিপূর্ণ সুস্থ হতে হবেl নাহলে বিজয়ের উল্লাস কিভাবে করবl আমার সাথে আমার স্ত্রী ও ফেরারি কারণ অন্যান্য ওষুধের সাথে চোখের চারটি ড্রপ ব্যবহার করতে হতো এক ঘন্টা দুই ঘন্টা পর পরেl আর মোবাইল ফোন ও সোসাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট সেতো ডিএক্টিভেট সেই ১৮ তারিখ থেকে সুতরাং ট্রাকিং করার কোন উপায় ছিল নাl কত অজানা অচেনা পরিবেশে কত না বাসায় থেকেছি সে আর নাইবা বলিl সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়েছিলাম সেই বন্ধুর কাছে, যার ভাই একজন ডিআইজি মহোদয়l ডিআইজি মহোদয় এ যাবৎ ৯ বার আমাকে বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার কারণে পুলিশি ছোবল থেকে রক্ষা করেছেন, ধন্যবাদ প্রিয় ভাইকেl বন্ধু ঘণ্টাখানেক পরে ফোনে জানালো ভাইয়া তোমাকে একটু সাবধানে থাকতে বলেছেl উপর মহল থেকে প্রশাসনের উপরে অনেক চাপl বুঝতে আর বাকি নেই প্রিয় ভাইটা আমার অসহায়l
এভাবে চলতে থাকে আমার লুকোচুরির গল্প এক একটা দিন কয়েকটা দিনের মতো মনে হতো আর শুধু অপেক্ষা করতাম কখনো স্বৈরশাসক মুক্ত একটি নতুন ভোর হবে, বাংলার মানুষ কবে মুক্তি পাবেl নামাজ বাদে মহান রবের কাছে ফরিয়াদ করতাম হে রব তুমি হাসিনাকে আরো কঠোর থেকে কঠোরতম করে দাও এবং আমাদের মুক্তি দাও l কি আমার ফরিয়াদ টা একটু উল্টো লাগছে? এই ফরিয়াদটা এই ভেবে করতাম হাসিনা যত কঠোর হবে প্রশাসন তত উগ্র হবে পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বেড়ে আন্দোলন আরও জোরালো হবে এবং স্বৈরশাসকের পতন হবে l মহান রব আমার ফরিয়াদ কবুল করেছেন l নামাজ সেজদা দিয়ে পড়তে পারি না এখনো পর্যন্ত কারণ সেজদারের স্থানেই আছে তিনটি বুলেটl প্রতিদিন একটি করে চোখের ছবি তুলতাম আর পূর্বের দিনের সাথে মিলাতাম একটু পরিবর্তন হয়েছে কিনাl
গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে বড় মেয়ে সাওদা ব্যালকনিতে গিয়ে জোরে জোরে চিল্লাইয়া কান্না করছে বাবা তুমি কোথায়, বাবা তোমার কি হয়েছে l ফয়েজ আমার স্ত্রীকে বলে ভাবি সাওদাকে ভিতরে নিয়ে আসেন লোকেরা জানলে আপনাদেরও বাসায় থাকতে দিবে নাl এই লোকেরা কারা? যাদের জন্য আমার অবুঝ শিশুও প্রাণ খুলে আর্তনাদ করতে পারেনি l
হাসিনা পালায় না এই কথা বলার ১০ দিনের মাথায় শেখের বেটি ঠিকই পালিয়েছে, ঘা ডাকা দিয়েছে সেই সব লোকরা l
অবশেষে তাদের কথিত শোকের মাস রুপন্তর হলো বিজয়ের মাসেl বাংলার মানুষ মুক্ত হলো, স্বাধীন হলো ৫ই আগস্ট ২০২৪ইং তারিখেl
মুক্তির বিনিময় ছিল আবু সাঈদ মুগ্ধসহ ২০০০ হাজারের ও অধিক তরুণের লাশ ও আমার মত ৩০ হাজারের ও অধিক যুবকের অঙ্গহানি l
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দল, সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ছাত্র, অভিভাবক সহ প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জড়িত সকল সাধারণ মানুষের প্রতিl
শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যারা জাতিকে নিজ প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, সমবেদনা রইল সকল আহতদের প্রতি l
হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে বিচারিক কার্যক্রমের পক্ষে যারা, আমি একটু তাদের উল্টো l হাজার হাজার যুবকের রক্তে ভেজা এই পবিত্র মাটিতে, হাসিনার কবর ও যেন না জুটে এটাই আমি ও আমাদের কাম্য।
দেশটা আজ স্বাধীন, এভাবেই স্বাধীন থাক। কোনদিন যেন আর কোনো স্বৈরশাসক মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারেl ভালো থাকুক দেশের সর্বস্তরের মানুষl
Daily Bangladesh Bani বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দৈনিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের প্রচার করি।