মো. হাসনাইন॥
গণগ্রন্থাগার সমাজের সকল শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বয়স ও পেশার মানুষের জন্য উন্মুক্ত জ্ঞান ও তথ্য আহরণের একটি গুরূত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান। একটি আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। মানব সভ্যতার সূচনা ও বিকাশ এবং ধারাবাহিকতার অমূল্য তথ্যাবলী পুস্তকে গ্রন্থিত থাকে। গ্রন্থাগার সেই সংখ্যাতীত পুস্তকের বিপুল সমাহারকে সযত্নে ধারণ করে এবং তার সহজ ব্যবহারে সকলকে সুযোগ করে দেয়। আর সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। বর্তমানে এই অধিদপ্তরের অধীন সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারসহ বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা ও শাখা পর্যায় মোট ৭১টি সরকারি গণগ্রন্থাগার পরিচালিত হচ্ছে।
দেশের ৭১ টি সরকারি গণগ্রন্থাগারের মধ্যে অন্যতম একটি বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগার, বরিশাল যা নগরীর কলেজ রোডস্থ বৈদ্যপাড়া মোড়ে নিজস্ব জমিতে চারতলা বিশিষ্ট ভবনে অবস্থিত। ভবনের দুইতলা বিশিষ্ট সংযুক্ত ভবনে অফিস কক্ষের পাশাপাশি একটি সেমিনার কক্ষ রয়েছে। নিজস্ব জায়গায় ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৬ তারিখে এর কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর থেকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শতাধিক পাঠককে পাঠকসেবা, তথ্য ও রেফারেন্স সেবা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও বরিশাল বিভগের ৬ টি জেলায় রয়েছে একটি করে সরকারি গণগ্রন্থাগার। এই গণগ্রন্থাগারগুলোর সার্বিক দেখাশোনার কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বরিশাল বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগার।
উপ-পরিচালক ড. মোঃ আহছান উল্যাহ জানান, এই গণগ্রন্থাগারে রয়েছে সুবিশাল তিনটি পাঠকক্ষ, একটি সেমিনার হলসহ মনোরম একটি ক্যাম্পাস যেখানে পাঠকেরা মুক্ত পরিবেশের স্বাদ নিতে পারেন। এখানে রয়েছে দুষ্প্রাপ্য বই, রেফারেন্স বই, ম্যাপ, এটলাসসহ মূল্যবান অসংখ্য পুস্তক। বর্তমানে এই গ্রন্থাগারে মোট পাঠসামগ্রী সংগ্রহের সংখ্যা ৭৫ হাজারের অধিক । পাঠকরা গ্রন্থাগারে বসে পাঠ করার পাশাপাশি পাঠসামগ্রী ধার করে বাসায় নিয়েও পড়তে পারেন। সব বয়সের ও সব শ্রেণির পাঠকেরা তাদের প্রয়োজনীয় পুস্তক এখান থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। তাছাড়া এটি দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীর এক বিশাল ভান্ডার। পুস্তকের পাশাপাশি পাঠকরা এখানে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সেবাও পেয়ে থাকেন। এই গ্রন্থগারের অন্যতম বিশেষ দিক হলো বিভিন্ন চাকুরী ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা সহায়ক পুস্তক নিয়ে এখানে রয়েছে ‘জব্স কর্ণার’ এবং প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ জন পাঠক এখানে সেবা নিতে আসেন।
তিনি বলেন, এই গ্রন্থাগারের অন্যতম আরেকটি কাজ হলো জাতীয় দিবস ভিত্তিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসটি প্রতিবছর জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে যথারীতি পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে সৃজনশীল প্রতিযোগিতা, র্যালী, আলোচনা সভা, সম্মাননা পদক ও পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিশেষ করে মহান বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিবস উপলক্ষে রচনা, চিত্রাংকন, হাতের সুন্দর লেখা, গল্প বলা, আবৃত্তি, বিতর্ক ও কুইজ প্রতিযোগিতার আয়াজন করা হয় যা শিক্ষার্থী ও সাধারণ মহলকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে দারুণভাবে উদ্বুদ্ব করে।
পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তির অভাবিত উন্নয়নে জ্ঞানার্জনের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটও এখন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। সে পরিবর্তনের প্রভাব গ্রন্থাগারগুলিতেও পড়েছে। বাংলাদেশের গ্রন্থাগারগুলো ইতোমধ্যেই সে ধারায় শামিল হয়েছে। গ্রন্থাগারগুলোতে তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক লেখাপড়ার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। ক্রমাগত বাস্তবায়নাধীন এসব প্রকল্পসমূহের মাধ্যমে একদিকে যেমন গ্রন্থাগারের অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, অন্যদিকে গ্রন্থাগারসমূহে পাঠক সমাজের চাহিদানুকূল প্রয়োজনের নিরীখে অনলাইনভিত্তিক পড়াশোনা এবং প্রযুক্তিভিত্তিক তথ্য প্রাপ্তির সুবিধাদিও নিশ্চিত করা হচ্ছে।
সর্বোপরি মানুষের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রতকরণ, উন্নত জীবনবোধ গঠন ও মানবিক জ্ঞানসমৃদ্ধ জাতি গঠনে গ্রন্থাগারের প্রসার ও ব্যবহারের বিকল্প নেই।কেননা দেশের মানুষ গ্রন্থাগারে নিয়মিত পড়াশোনার মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ মানবসম্পদে পরিণত করেন। এছাড়া যুবসমাজকে ইতিবাচক চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে সমাজে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ যেমন বেকারত্ব, হতাশা, মাদকাসক্তি, জঙ্গিবাদ প্রভৃতি নির্মূলের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান হতে পারে গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারের উন্নয়নে সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কার্যক্রম সামগ্রিকভাবে গ্রন্থাগার সেবাকে আরও আধুনিক ও সময়োপযোগী করবে।
লেখকঃ সহকারী তথ্য অফিসার,আঞ্চলিক তথ্য অফিস, বরিশাল।