শুক্রবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৫

শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সাঁতার শেখানো প্রকল্পে চলছে লুটপাট

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং সাঁতার শেখানোর জন্য নিয়োজিত আছে ১হাজার যত্নকারী ও সহকারী যত্নকারী। এদের দেখভাল করার জন্য রয়েছেন ১জন করে সুপারভাইজার। তবে বেশি কেন্দ্র রয়েছে, সেসব ইউনিয়নে রয়েছে ২জন করে।

উপকূলীয় জেলা ভোলার ৩টি উপজেলা ভোলা সদর, লালমোহন ও মনপুরায় ৫’শ শিশু যত্ন-কেন্দ্রে এক থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সি মোট ভর্তিকৃত শিশু দেখানো হয়েছে ১২হাজার ৫০০জন। সব আয়োজনই ঠিকঠাক, তবে শুধুই কাগজ-কলমে। বাস্তবে খোলা দিনে প্রায় যত্ন-কেন্দ্রেগুলোতে কোনো শিশুই দেখা যায়নি। তালিকায় নাম থাকলেও অনেক কেন্দ্রের কোনো অস্তিত্বও নেই। যেসব যত্ন কেন্দ্রগুলো রয়েছে সেগুলোর কার্যক্রম দেখানো হয় ছবির মাধ্যমে। আশপাশের শিশুদের খাবারের কথা বলে এনে কেন্দ্রে বসিয়ে তোলা হয় ছবি, এরপর হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পাঠিয়ে দিয়ে দেখানো হয় কার্যক্রম।

ভোলার এই ৩টি উপজেলায় শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং সাঁতার শেখানো সুবিধা প্রধান (আইসিবিসি) প্রকল্প মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে ‘পদক্ষেপ, এনজিও সংস্থার কার্যক্রমের চিত্র এটি। ‘শিশু একাডেমি, প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘পদক্ষেপ, এনজিও’র মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে এই কর্যক্রম পরিচালনা করছে। জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারী মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দেশের উপকূলীয় ১৬জেলার ৪৫উপজেলায় শিশুদের সমন্বিত ইসিডি সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ২৭১কোটি ৭২লাখ টাকা ব্যয়ে ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু-যত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং সাঁতার সুবিধা প্রদান প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার।

শিশু একাডেমির তথ্য মতে, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ভোলার উপকূলীয় ৩উপজেলায় (কাগজে-কলমে) ৫’শ টি শিশু যত্ন-কেন্দ্র উদ্বোধন করা হয়। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত প্রতিটি কেন্দ্রের যত্নকারী ৪হাজার, সহকারী যত্নকারী ১হাজার এবং সুপারভাইজারদের জন্য প্রায় ২০হাজার টাকা বরাদ্দ আছে। এছাড়াও যত্নকারী ও সহকারী যত্নকারীদের প্রশিক্ষনের জন্য আলাদা বরাদ্দ ছিলো দৈনিক ৫’শ টাকা করে ।

প্রতিটি কেন্দ্রের বৈদ্যুতিক ফ্যান, বোর্ড, খেলনা, বই, ডাস্টবিন ইত্যাদি উপকরণ দেওয়া কথা, যা ছিলো প্রকল্পের শর্ত । নিয়ম নীতি তোয়াক্কা না করে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই টাকার বিনিময়ে গোপনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যত্নকারী, সহকারী যত্নকারী এবং সুপারভাইজারদের।

এদের ঠিক মতো দেওয়া হয়নি প্রশিক্ষণও । ৩দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের বলতে বলা হয়েছে ৭দিনের কথা। তাও ভাতা ৫’শ টাকার পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে ১’শ টাকা করে। শুরুর ৩ মাস প্রকল্পের কর্যক্রম কিছুটা স্বাভাবিক ছিলো ।

এরপর থেকে শুরু হয় কর্যক্রম ও যত্ন-কেন্দ্রগুলো তত্বাবধানে অনীহা । যত্নকারী ও সহকারী যত্নকারীরা নিয়মিত বেতন পান না, সবগুলো যত্ন-কেন্দ্র সচল না করে প্রতি মাসেই উত্তলন করা হয়েছে ৫’শ কেন্দ্রের ১হাজার জনের বেতন-ভাতা । অপরদিকে যে সকল কেন্দ্র সচল রয়েছে তারা ১১মাসের মধ্যে ছয়-সাত মাসের বেতন পেলেও কমিশন দিতে হয় বাস্তবায়ন ‘কর্তা’ ব্যক্তিদের । তাও আবার সবাই সমানভাবে পাননি বেতন-ভাতা ।

এসব দুর্নীতি নিয়ে যারাই প্রতিবাদ করেছে তাদেরই কেন্দ্র বাতিল করে চাকুরী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে । এছাড়াও শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যত্ন কেন্দ্রগুলো পায়নি সকল উপকরণ । এই জেলাতে প্রকল্প শুরুর ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও সাঁতার শিখানো কর্যক্রম এখনো সকল জায়গায় দৃশ্যমান হয়নি । সরেজমিনে ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে প্রকল্পের এমন দৈন্যদশার চিত্র জানা গেছে ।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক অভিভাবক বলেন, ‘সরকারের টাকা লুটপাট ছাড়া কিছুই হচ্ছে না এ প্রকল্পে । আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনই ছিল এ প্রকল্পের মূল কার্যক্রম।’ স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ও বাস্তবায়ন সংস্থা মিলেমিশেই এ লুটপাটের অংশীদার ।

একাধিক জনপ্রতিনিধি জানান, শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং সাঁতার শিখানো নামে কেন্দ্র ও তালিকা উপস্থাপন করে শুধু প্রকল্পের টাকা লুটে খাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা ।

কথা হয়, ভোলা সদর উপজেলার সমাজ সেবক ও শিক্ষক মো. ইয়াসিন শরীফ’র সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ বাণীকে বলেন, শুরুতে এই ইউনিয়নে অনেকগুলো শিশু যত্ন-কেন্দ্র ছিলো । তালিকায় কেন্দ্র কোড থাকলেও এগুলোর সচল করা হয়নি । এমনকি তাদের সাথে যোগাযোগও রাখেনি তারা । তবে তারা অফিসিয়াল ভাবে কেন্দ্রগুলোর নাম ব্যবহার করছেন।

’পরিচয় গোপন রাখার শর্তে প্রকল্পের শিশু যত্ন-কেন্দ্রের একাধিক যত্নকারী জানান, গত ১০-১১ মাসে প্রত্যেক যত্নকারী সাকুল্যে প্রায় ১৫হাজার ও সহকারী যত্নকারী ৫হাজার টাকা পেয়েছেন । অথচ ১০-১১ মাসে প্রতিটি কেন্দ্রে সবমিলিয়ে বেতন পাওয়ার কথা প্রায় অর্ধ-লাখ টাকা । এরমধ্যে আবার বেতন-ভাতা সবাই সমানভাবে পাননি, কেউ কম কেউ আবার বেশি পেয়েছে। আবার তালিকায় কেন্দ্রের নাম ও কোড থাকার পরও অনেকে এক টাকা বেতনও পায়নি । যারা পেয়েছে এ টাকা থেকে আবার কমিশনও দিতে হয়েছে বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্পের ইউনিয়ন এক সুপারভাইজারের ভাষ্য, আমার ইউনিয়নে সকল কেন্দ্র সচলও করা হয়নি । কিন্তু যখন প্রকল্প শুরু হয়েছে তখন সবই চলছিলো । হঠাৎ ইসিসিডি অফিসারের নির্দেশে অনেকগুলো কেন্দ্র বন্ধ করে দেই । এছাড়া এ ইউনিয়নে যেসব কেন্দ্র সচল আছে সেগুলোতে সকল উপকরণ দিতে পারিনি । বড় স্যারকে জানালে তিনি বলেন, বাজেট আসলে দিবেন।

কথা হয় ‘পদক্ষেপ, প্রোগ্রাম ম্যানেজার হারুনের সঙ্গে। বাংলাদেশ বাণীকে তিনি বলেন, ‘গত দুই মাস ছাড়া কেন্দ্রের যত্নকারী, সহকারী যত্নকারী এবং সুপারভাইজারদের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। যেসব অভিযোগ এসেছে তার সততা নেই বলে অস্বীকার করেন তিনি ।

শিশু একাডেমির কর্মকর্তা ও মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব মো. আকতার হোসেন বলেন, এসব অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। আমি হেড অফিসে রিপোর্ট দিয়েছি। সেদিনও মনপুরা থেকে পারভীন নামে একজন যত্নকারী ফোন কলে বেতন পায়নি বলে অভিযোগ করেছে। আমি তাৎক্ষণিক বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্যে এপিএম’কে নির্দেশ দেই।

জেলা প্রশাসক ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি মো. আজাদ জাহানের ভাষ্য, ‘খোঁজখবর নিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে । তবে শিগগিরই জেলা মনিটরিং কমিটিকে সভা করার নির্দেশনা দেওয়া হবে।

আরো পড়ুন

বাবুগঞ্জের ইউএনও’র বদলি স্থগিতের দাবিতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে মানববন্ধন

বাবুগঞ্জ প্রতিনিধি।। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার জনপ্রিয়, জনবান্ধব ও মানবিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারুক আহমেদের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *