শুক্রবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৫

হেদায়েতের আলোকবর্তিকা খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:)

বিশেষ প্রতিবেদক।।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে যুগে যুগে আধ্যাত্মিক সাধক ও সুফি-দরবেশগণ সত্য, ন্যায়, নৈতিকতা ও মানবিকতার আলো ছড়িয়েছেন। তাঁরা ছিলেন সমাজের বিবেক, অশান্ত পৃথিবীতে শান্তির দূত এবং হেদায়েতের বাতিঘর। বাংলার আধ্যাত্মিক ইতিহাসে হযরত শাহসুফী খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:) (১৮৫৪-১৯৫৫) ছিলেন তেমনই এক জন আধ্যাত্মিক আলোকবর্তিকা। তাঁর জীবন, কর্ম ও শিক্ষায় আমরা পাই এমন দিকনির্দেশনা, যা কেবল ধর্মীয় নয় বরং সামাজিক ও নৈতিক পরিমণ্ডলেও আমাদের জন্য চিরন্তন শিক্ষা হিসেবে প্রযোজ্য।

খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:) ১৮৫৪ সালে (হিজরি ১২৭০ সালে) বাকেরগঞ্জ জেলার মরিচবুনিয়ায় এক আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধ মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শাহসুফী খাজা ছলেমউদ্দীন (রহ.) ছিলেন একাধারে আলেমে দ্বীন, আধ্যাত্মিক সাধক ও সমাজে সুপরিচিত বুযুর্গ। পারিবারিক আধ্যাত্মিক বংশধারা গিয়ে মিশে আছে মহান সুফি সম্রাট বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ:), ইমাম হোসাইন (রা:), আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (রা:) ও ফাতেমা (রা:)-এর সাথে। এই আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারই তাঁর জীবনের মূল ভিত্তি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। ফলে তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করেছিলেন সুফিবাদের সেই প্রকৃত শিক্ষা, যা কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিকশিত। তাঁর ভেতরে ছিল দিব্যজ্ঞান, মানবপ্রেম, দয়া ও আধ্যাত্মিক শক্তির এক অনন্য সমন্বয়।

আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মেও দেখা যায় ইসলামী শিক্ষার দীপ্তি। তাঁর স্নেহধন্য সাধকপুত্র সুফী মৌলভী খাজা নাছের আলী (রহ:) আধ্যাত্মিক সাধনায় খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর প্রিয় দৌহিত্র হযরত মাওলানা আবুল খায়ের মুহাম্মাদ ইসমাইল (বড় হুজুর) বর্তমান সময়ের একজন দাঈ ইলাল্লা এবং ফিকাহ ও হাদিস শাস্ত্রের বিশিষ্ট পণ্ডিত। আর তাঁর প্রপৌত্র খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী আধুনিক সময়ে গবেষক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী হিসেবে তাঁর বংশের মর্যাদা ধরে রেখেছেন।

খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:) ছিলেন গভীর আল্লাহভীরু, তাকওয়াবান এবং জিকির-আজকারে অভ্যস্ত একজন প্রকৃত সাধক। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাহ্যিক সাধনার চেয়ে অন্তরের সংস্কার অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে, প্রকৃত ইবাদত হলো অন্তরের পবিত্রতা, প্রকৃত সৌন্দর্য হলো উত্তম চরিত্র এবং প্রকৃত সাফল্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তিনি ভক্তদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিতেন যে কুরআনের শিক্ষা মুখস্থ করলেই হবে না, বরং তা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাঁর খানকায় আগত মানুষকে তিনি সর্বপ্রথম আত্মশুদ্ধি ও নৈতিকতার শিক্ষা দিতেন।

আধ্যাত্মিক সাধনার পাশাপাশি মানবকল্যাণে নিবেদিত ছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত “গাউসুল আজম খানকা শরীফ” স্থানীয় মানুষের জন্য হয়ে উঠেছিল দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের কেন্দ্রস্থল। দরিদ্র-দুঃখী মানুষ যেমন সেখানে ভরসা খুঁজে পেতেন, তেমনি বিদগ্ধ আলেম ও সুফিগণও পেতেন আধ্যাত্মিক শিক্ষা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল এই খানকা শরীফ। মানুষ আসতো কেউ ভগ্নহৃদয় নিয়ে, কেউ পারিবারিক সমস্যায় জর্জরিত, কেউ অর্থনৈতিক কষ্টে, আবার কেউ নৈতিক অবক্ষয়ে নিমজ্জিত। সকলের কথা তিনি ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং কুরআন-হাদিসের আলোকে তাদের পথনির্দেশ করতেন। এভাবেই তাঁর খানকা পরিণত হয়েছিল এলাকার আলোকিত এক আধ্যাত্মিক কেন্দ্রে, যা অনেকেই ‘কাচারি’ নামেও ডাকত।

খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:) এর সমগ্র জীবন ছিল মানুষের কল্যাণ, আত্মশুদ্ধি ও সত্যনিষ্ঠার শিক্ষা প্রদানের জন্য নিবেদিত। তাঁর জীবনাদর্শ প্রমাণ করে যে প্রকৃত আধ্যাত্মিক সাধনা শুধু ব্যক্তিগত মুক্তির পথ নয়, বরং সমাজকে আলোকিত করারও মাধ্যম। তাঁর শিক্ষার মূলকথা ছিল—আল্লাহর প্রেম, মানবসেবা, নৈতিকতার চর্চা এবং অন্তরের পরিশুদ্ধি। তাই তিনি আজও স্মরণীয় একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব, যিনি ছিলেন হেদায়েতের এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।

আরো পড়ুন

ঝালকাঠিতে খবরেরকাগজ ‘বন্ধুজন’ জেলা কমিটি গঠন

জাহাঙ্গীর আলম।। দৈনিক খবরের কাগজ–এর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বন্ধুজন’–এর ঝালকাঠি জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। মঙ্গলবার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *