মইনুল আবেদিন খান সুমন, বরগুনা
বাংলাদেশজুড়ে ব্যক্তিগত ঋণ দেওয়ার নামে ভয়ংকর এক প্রতারণা নীরবে বিস্তার লাভ করছে। ব্ল্যাংক চেককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, অসহায়ত্ব এবং বিশ্বাসকে ব্যবহার করে একটি সুসংগঠিত প্রতারণা চালাচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গ্রাম থেকে শহর—দেশের প্রায় সব এলাকায় একই কৌশলে মানুষের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে সুদখোরদের একটি শক্তিশালী চক্র।
প্রতারণার শুরু হয় মানুষের আর্থিক সংকটকে কেন্দ্র করে। চিকিৎসা, ব্যবসা, জরুরি প্রয়োজন বা পারিবারিক সমস্যার সময় দ্রুত টাকা পাওয়ার আশায় অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে ঋণ নেন। আর এই মুহূর্তটিকে কাজে লাগায় সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তারা প্রথমে সহানুভূতিশীল আচরণ করে বিশ্বাস অর্জন করে। সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তারা এমন পরিবেশ তৈরি করে যেখানে ভুক্তভোগীর কাছে সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু টাকা দেওয়ার আগে তারা যেসব শর্ত চাপায় তা-ই পরবর্তীতে ভয়াবহ ফাঁদে রূপ নেয়। খালি ব্যাংক চেক, খালি স্ট্যাম্প, সাদা কাগজ, পরিচয়পত্রের কপি—সবকিছুতেই স্বাক্ষর নিয়ে নেয় তারা, যা পরে প্রতারণার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
টাকা হাতে দেওয়ার পরই বদলে যায় সুদখোরদের আচরণ। প্রথমে যা সহজ কিস্তির কথা বলা হয়েছিল, তা পরিণত হয় অস্বাভাবিক সুদের দাবিতে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এক লাখ টাকার বিপরীতে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত দাবি করা হয়। নির্ধারিত সময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হলে তারা খালি চেকগুলোতে নিজেদের ইচ্ছামতো অঙ্ক বসিয়ে ব্যাংকে পাঠায়, যা স্বাভাবিকভাবেই ডিসঅনার হয়। এরপর শুরু হয় আইনি চাপ। উকিল নোটিশ পাঠানো হয় এবং নির্ধারিত সময় শেষ হলে মামলা করা হয় এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায়। এই আইনটি মূলত ব্যবসায়িক লেনদেন সুরক্ষার জন্য তৈরি হলেও এখন সিন্ডিকেটের হাতে এটি পরিণত হয়েছে প্রতারণার বৈধ অস্ত্রে।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আদালতে মামলা গ্রহণের সময় বাদীর টাকার উৎস বা লেনদেনের প্রকৃততা যাচাই না করাই এ চক্রের শক্তির মূল ভিত্তি। স্বাক্ষর মিললেই মামলা গ্রহণ হয়, কিন্তু বাদী আসলে সেই অঙ্কের টাকা দিয়েছিল কি না—তা অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিকভাবে খতিয়ে দেখা হয় না। এই সুযোগকে কেন্দ্র করেই সিন্ডিকেট সাধারণ মানুষকে আইনের ভয়ে জিম্মি করে বিপুল অঙ্কের অর্থ আদায় করে। ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই আইনি জটিলতা বোঝেন না। আর এ জ্ঞানহীনতাই তাদেরকে আরও দুর্বল অবস্থায় ফেলে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই প্রতারণা কোনো ব্যক্তির একক কাজ নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ নেটওয়ার্ক। ঋণদাতা, সুদ আদায়কর্মী, মামলার বাদী হিসেবে ব্যবহৃত ভাড়াটে লোক, নোটিশ প্রস্তুতকারী এবং আদালতপাড়ার দালাল—সবাই একসঙ্গে কাজ করে। ফলে ভুক্তভোগী বুঝতেই পারেন না কোথায়, কার হাতে, কত বড় প্রতারণার জালে তিনি জড়িয়ে গেছেন। এই নেটওয়ার্ক এতটাই সংগঠিত যে একটি মামলাই যথেষ্ট একজন পরিবারের আর্থিক ভিত্তি ভেঙে দিতে। মানুষের জমি-বাড়ি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, সঞ্চয় শেষ হয়ে যাচ্ছে, সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছেন অনেকেই। কেউ কেউ আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন, আবার কেউ মানসিক চাপে চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
এই প্রতারণা রোধে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন। কোনো অবস্থাতেই খালি চেক বা সাদা কাগজে স্বাক্ষর না করা, নগদ লেনদেন এড়িয়ে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করা এবং ব্যক্তিগত ঋণের ক্ষেত্রে লিখিত চুক্তি বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে লাইসেন্সবিহীন সুদ ব্যবসার বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান, আদালতে প্রাথমিক প্রমাণ যাচাই প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা এবং প্রতারণামূলক মামলা ফিল্টার করার দাবিও উঠেছে জোরালোভাবে।
ব্ল্যাংক চেককে কেন্দ্র করে পরিচালিত এই প্রতারণা এখন একটি গুরুতর সামাজিক সংকটে পরিণত হয়েছে। অনুসন্ধানে স্পষ্ট—এই চক্র যতদিন আইনের দুর্বল দিকগুলো ব্যবহার করতে পারবে, ততদিন সাধারণ মানুষ নিরাপদ নয়। সময় থাকতে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে আরও বহু পরিবার নিঃস্ব হবে, এবং সুদখোরদের প্রতারণা আরও বিস্তার লাভ করবে। অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে পরিচালিত এই অমানবিক ব্যবসাকে থামাতে এখনই সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি।
Daily Bangladesh Bani বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দৈনিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের প্রচার করি।