শুক্রবার, ডিসেম্বর ১২, ২০২৫

আযাদ আলাউদ্দীন : তৃণমূল সংবাদকর্মী থেকে সম্পাদক

আহমেদ বায়েজীদ :

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে মফস্বল সাংবাদিকতার আলোকিত মুখ আযাদ আলাউদ্দীন। তৃণমূল পর্যায় থেকে সাংবাদিকতা করে বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ স্তর সম্পাদক হয়েছেন তিনি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আযাদ আলাউদ্দীন সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংগঠক ও সাহিত্যসেবী হিসেবেও পরিচিত। আছে আরো বিভিন্ন ধরণের সমাজকল্যাণমূলক কর্মকান্ডের সাথে সংশ্লিষ্টতা।

তবে সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি মূলত একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকতাই যার ধ্যান-জ্ঞান।মোটা দাগে বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে দুই ধরণের সংবাদকর্মী আছেন। এক. যারা মনে প্রাণে সংবাদকর্মী। অর্থাৎ এই পেশাটাকেই জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বানিয়েছেন। সুযোগ থাকলেও অন্য পেশায় যাননি। এই ক্যাটাগরিতে পড়বেন এরকম লোকসংখ্যা এদেশের গণমাধ্যম জগতে খুব বেশি নয়। এরা হাজারো কষ্ট সহ্য করেও সংবাদের সাথেই থেকে যান। সাংবাদিকতায় আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই, চাকরির নিশ্চয়তা নেই, নিয়মিত বেতন হয় না, বেতন হলেও চাকরি স্থায়ী হয় না- এসব জানার পরেও পাগলের মতো লেগে থাকেন।

দ্বিতীয় আরেকটি শ্রেণি আছেন যারা নিছক চাকরি করা দরকার, তাই করছি। অপেক্ষাকৃত ভালো সুযোগ পেলে অন্য যে কোন পেশায় চলে যাবেন। কিংবা অন্য পেশায় ভালো সুযোগ হয়নি তাই সাংবাদিকতা করছেন।এই দুটো ক্যাটাগরির মধ্যে আযাদ আলাউদ্দীনকে প্রথমটিতে ফেলতে হবে। যার সাংবাদিকতার শুরুটা ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার মির্জাকালু নামের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে।স্কুলজীবনে দৈনিক পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে স্থানীয় ডাকঘরের সমস্যার কথা তুলে ধরতে গিয়ে যার লেখালেখির শুরু। লিখতে লিখতে একসময় সাংবাদিকতার নেশায় পেয়ে বসে। তারপর আর থামেননি কখনো।

কাজ শুরু করেন জাতীয় দৈনিক জনতার বোরহানউদ্দিন উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে। এসময় তাকে নিয়োগ পেতে সহযোগিতা করেন দৈনিক জনতার তৎকালীন সাহিত্য সম্পাদক কবি হাসান মাহমুদ। বর্তমানে তিনি ‘পূর্বাপর’ নামের একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক। সেই থেকে আযাদ আলাউদ্দীনের সাংবাদিকতার জগতে পা ফেলা। প্রত্যন্ত এলাকার একজন সংবাদকর্মী হিসেবে বেড়ে উঠে মূলধারায় যুক্ত হওয়া কতটা সংগ্রামময় তা আযাদ আলাউদ্দীনের কর্মজীবনের দিকে তাকালে টের পাওয়া যাবে। বাড়ি থেকে ১০/১২ কিলোমিটার দূরের উপজেলা শহরে প্রতিদিন পায়ে হেঁটে কিংবা বাইসাইকেলে চলে যেতেন সাংবাদিকতার টানে। সংবাদ সংগ্রহ করে তারপর সেগুলো পাঠাতে হতো ঢাকায়। ছাত্রজীবনে কোন পারিশ্রমিক ছাড়া পকেটের পয়সা খরচ করে শখের এই কাজের পেছনে তারাই ছুটতে পারেন যাদের আছে এই পেশার প্রতি অদম্য নেশা।

মাধ্যমিকের পর জেলা শহরে এসে নিয়োগ পান সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র ভোলা জেলা সংবাদদাতা হিসেবে। ১৯৯৮ সালে বরিশাল বিএম কলেজে অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর সাংবাদিকতার এই নেশা আরো তীব্রভাবে জেঁকে বসে। শুরু হয় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা। এসময় বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে অনবরত ফিচার লিখেন তিনি। সেই সাথে তৈরি হয় বৃহত্তর ফ্রন্টে কাজে নামার সুযোগ। অনার্স পরীক্ষা শেষে২০০২ সালে যুক্ত হন বরিশাল থেকে প্রকাশিত স্থানীয় দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে।অল্প দিনেই পত্রিকা কর্তৃপক্ষের আস্থা অর্জন করেন। যে কারণে পদোন্নতি পেয়ে পর্যায়ক্রমে হয়ে যান সিনিয়র রিপোর্টার, চিফ রিপোর্টার ও বার্তা সম্পাদক। সেই সাথে চলতে থাকে দু’হাতে ফিচার লেখা। জাতীয় বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে বিভিন্ন বিষয়ে ফিচার লিখতে থাকেন।

আযাদ আলাউদ্দীনের সাংবাদিকতার পরের ধাপটি ছিলো জাতীয় গণমাধ্যমে যুক্ত হওয়া। বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স পাশ করে ২০০৪ সালে দৈনিক নয়া দিগন্তের বরিশাল ব্যুরো অফিসে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে পেশাদার সাংবাদিকতার জগতে পা রাখেন। এরপর পাশাপাশি যুক্ত হন বৈশাখী টেলিভিশন ও পরে দিগন্ত টেলিভিশনে। ২০১৩ সালে দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ হওয়া পর্যন্ত কাজ করেছেন বরিশাল ব্যুরো চিফ হিসেবে। নয়া দিগন্তেও পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে এখনো কাজ করে যাচ্ছেন ব্যুরো প্রধানের পদে। এর ফাঁকে কাজ করেছেন বরিশাল বেতার, স্থানীয় দৈনিক বরিশাল বার্তা ও দৈনিক ভোরের আলো’র বার্তা সম্পাদক হিসেবে।

বলা হয়ে থাকে, একজন সাংবাদিকের ক্যারিয়ারের পূর্ণতা পায় পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার মাধ্যমে। আযাদ আলাউদ্দীন সাফল্যের সেই ধাপটিতে পা রাখেন ২০২৪ সালের নভেম্বরের ১ তারিখে। সেদিন থেকে তার সম্পাদনায় নতুন রূপে বের হয় বরিশালের স্থানীয় দৈনিক ‘বাংলাদেশ বাণী’। এর মধ্য দিয়ে সম্পাদক হিসেবে যাত্রা শুরু হয় এই নিবেদিত প্রাণ এই সংবাদকর্মীর।

‘বৈষম্যের বিরুদ্ধে’ স্লোগান নিয়েনতুন রূপে বাজারে এসে অল্প দিনেই পাঠক মহলে সারা ফেলে বাংলাদেশ বাণী। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে মুক্ত গণমাধ্যমের ওপর পাঠকের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে তা এই সংবাদপত্রটি কতটা পূরণ করতে পেরেছে সেটি মূল্যায়নের ভার পাঠকদের ওপর রেখে শুধু এটুকু জানাতে চাই যে, পত্রিকাটি মাত্র কয়েক মাসেই বিভাগীয় শহর বরিশালে প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে উঠে আসে।

দীর্ঘ সাংবাদিকতার ক্যারিয়ারে আযাদ আলাউদ্দীনের কলম ও মাইক্রোফোনে উঠে এসেছে বরিশাল অঞ্চলের নানা ঘটনা প্রবাহ। অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসা অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে যেমন তুলে এনেছেন প্রচারের আলোয়, আবার নানা অনিয়ম, অনাচারের ঘটনাও তুলে ধরেছেন পাঠক-দর্শকদের সামনে। ২০০৭ সালে প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় উপক‚লীয় বিপর্যস্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে তার তুলে আনা বিভিন্ন রিপোর্ট প্রশংসিত হয়েছে নানা মহলে।২০০৯ সালে ঈদের দিনে ভোলায় কোকো লঞ্চ ডুবির ঘটনায় দিগন্ত টেলিভিশনে স্পট থেকে তার পাঠানো রিপোর্টগুলো সারাদেশে আলোড়ন তুলেছিলো। এসব কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বিভিন্ন সম্মাননা।

বাংলাদেশে সাংবাদিকতা জগতের সবচেয়ে অবহেলিত সেক্টরগুলোর একটি মফস্বল। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই বিশাল সংবাদকর্মীর দল বেশিরভাগ সময়ই কর্তৃপক্ষের কাছে সঠিক মূল্যায়ন পান না। ঢাকার সাংবাদিকদের সাথে তুলনা করলে তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিতান্তই কম। অথচ এই সাংবাদিকরাই দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে সংবাদের জোগান দিয়ে থাকেন। তবুও তারা খুব কমই কর্তৃপক্ষের সুনজরে পড়েন। এসব কারণে মফস্বল সাংবাদিকতা বেশি চ্যালেঞ্জিং। এমন পরিস্থিতির মাঝেও যারা মফস্বলে বছরের পর বছর সাংবাদিকতা করেন তারা পেশাটাকে ভালোবেশেই থেকে যান। আবার অনেকে তাল মেলাতে না পেরে চলে যান অন্য পেশায়।

আযাদ আলাউদ্দীন তার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের পুরো সময়টা মফস্বল সাংবাদিক হিসেবেই পার করেছেন। ঢাকায় পত্রিকার হেড অফিসে অফার পেয়েও যাননি। এটিও তার পেশার প্রতি নিবেদনের বড় একটি দিক। শুধু তাই নয়, নিজ হাতে তৈরি করেছেন এক ঝাঁক সাংবাদিক। তরুণ ও শিক্ষানবীশ সাংবাদিকরা বরাবরই তার কাছে বটবৃক্ষের মতো ছায়া পেয়েছেন। পেশাগত মর্যাদা আর ব্যক্তিত্ব কখনো এসব ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়ায়নি, বরং তাকে উদার হতে সাহায্য করেছে। সংবাদ লেখা শেখানো, প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন, স্টোরির আইডিয়া দেয়া, লেখার পর সংবাদ সংশোধন করে দেয়া- এমন অনেক কিছু নিঃস্বার্থভাবেই করে যাচ্ছেন জুনিয়রদের জন্য। যে কারণে তার হাত ধরে গড়ে ওঠা অনেক সাংবাদিক এখন জাতীয় ও স্থানীয় মিডিয়ায় সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন।

বরিশাল অঞ্চলের সাংবাদিকদের অধিকারের দিকটিও ভাবায় এই মানুষটিকে। যে কারণে সাংবাদিকদের বিভিন্ন ফোরামে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন সুনাম ও দক্ষতার সাথে। বর্তমানে বরিশাল জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও বরিশাল প্রেসক্লাবসহবিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন সময়। বরিশাল বিএম কলেজ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা আহŸায়কও ছিলেন তিনি।

এসবের বাইরে সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও একজন তুখোর সংগঠক হিসেবে পরিচিতি আছে আযাদ আলাউদ্দীনের। ছাত্রজীবনে পরিচালক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন বরিশালের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীর।এখনো বরিশাল সংস্কৃতিকেন্দ্র, বাংলাদেশী সাংস্কৃতিক জোটকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার সম্পাদনায় ২০১৮ সালে বের হয় সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক ম্যাগাজিন মুক্তবুলি। যাত্রা শুরুর পর থেকে এই লিটলম্যাগটির এখন পর্যন্ত ৩৭টি সংখ্যা বের হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লিটলম্যাগের যাত্রা দীর্ঘ করা কঠিন। তা সত্তে¡ও স্বেচ্ছাশ্রম আর পকেটের পয়সা খরচ করে মুক্তবুলিকে টিকিয়ে রেখেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, এই ম্যাগাজিনটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিরাট একটি লেখক শ্রেণি। যারা নিজেদের প্রতিভা তুলে ধরার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছেন মুক্তবুলিকে।

সাংবাদিকতার বাইরেও আযাদ আলাউদ্দীনের লেখালেখির একটি জগত রয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখছেন নিয়মিত। সাংবাদিকতার বিভিন্ন দিক নিয়েও তার লেখালেখি অনেকদিনের। ২০২৩ সালের একুশে বই মেলায় ‘দেশজ প্রকাশন’ থেকে প্রকাশ পেয়েছে তার লেখা বই ‘সাংবাদিকতার বাঁকে বাঁকে’।

নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে আযাদ আলাউদ্দীন এ প্রতিবেদককে বলেন, জীবনের লক্ষ্য ছিলো সাংবাদিক হবো, সেজন্য যতধরনের সেক্রিফাইস করা দরকার সব করেছি। তৃণমূল থেকে শুরু করে সাংবাদিকতার সব স্তরে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করে অবশেষে দৈনিক ‘বাংলাদেশ বাণী’ পত্রিকার সম্পাদক সম্পাদক হয়েছি। এই পত্রিকাটি এখন বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে বেশি সার্কুলেশনের পত্রিকা।আমার জীবনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন মানুষের স্বপ্ন পূরণে আগের মতোই নিরন্তর কাজ করে যাবো। যতদিন বেঁচে থাকবো মানুষের কল্যাণের জন্যই হবে আমারসাংবাদিকতা।

আহমেদ বায়েজীদ সম্পাদক, বরিশাল জার্নাল

আরো পড়ুন

অপরিকল্পিত উন্নয়নে ধুঁকছে খাকদোন নদী

মইনুল আবেদীন খান সুমন, বরগুনা একসময়ের খরস্রোতা খাকদোন নদী-যা আজ নাব্যতা সংকট, দখলদারিত্ব ও অপরিকল্পিত …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *