শুক্রবার, জানুয়ারি ৩১, ২০২৫
ডিঙ্গি নৌকায় ভেসে বড়শি দিয়ে মাছ শিকারে ব্যস্ত জেলে
ডিঙ্গি নৌকায় ভেসে বড়শি দিয়ে মাছ শিকারে ব্যস্ত জেলে

বড়শির সুতোয় বাধা তাঁদের জীবন

লায়ন মো. শামীম সিকদার, বেতাগী: ডিঙ্গি নৌকায় ভেসে বিষখালী নদীতে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করাই তাঁর পেশা। শিকার করা মাছ বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে দেশের উপকূলীয় জনপদ বরগুনার বেতাগী পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা সোহরাব হাওলাদারের পরিবার। এখানে তার মতো আরও অনেকেই আছেন, যাদের সংসার চলে শুধু মাছ শিকার করে। বলা যায় মাছ শিকারই তাদের জীবন-জীবিকা ও প্রায় সারা বছর মাছ ধরে বা বেঁচেই কাটে তাদের জীবনধারা। অন্য কোন কাজ করেন না তারা। একই অবস্থা পৌর এলাকার হিরন হাওলাদার, আব্দুস সালাম ও মো: কবিরসহ অনেকের।]

এখানে নৌকায় চেপে নিয়মিত মাছ শিকার করেন সোহরাব হাওলাদার। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, বড়শিতে মাছ শিকার করেই চলছে তার এবং তারই মতো আরও বহু পরিবারের জীবন-সংসার। তিনি আরও বলেন, জীবিকার প্রয়োজনে দিন নেই, রাত নেই সকল ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে বছরের পর বছর ধরে শুধু মাছ শিকার করেই চলেছি। এখন এটাই পেশা, এটাই নেশা। এর রোজগার দিয়েই স্ত্রী, ছেলে- মেয়েদের পড়ালেখাসহ সংসার চলে তার। এমন কাজে জীবন পার করে দিলেও এদের অনেকে কিন্তু স্বীকৃত জেলে বা মৎস্যজীবী নন। এদের বিশেষ আর কোন পরিচয়ও নেই। অথচ মাছ ধরেই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। তারই কথার মাঝে আরেকজন মৎস্য শিকারি লাভলু মিয়া এসে আগ বাড়িয়ে বললেন, বছরের এই সময়টাই আসলেই মাছ শিকারের জন্য। এই সময়ে অন্য পেশার লোকজনও এসে শামিল হয় মাছ ধরায়। কেউ কেউ আবার নিজে খাওয়ার জন্যও শখের বশে মাছ ধরে থাকে। পরে আবার ফিরে যায় নিজ নিজ কর্মস্থলে। বাস্তবে উপার্জনের অন্য কোন উপায় না থাকায় এ উপজেলায় বড়শির সুতোয় বাঁধা পড়ে আছে সোহরাবের মতো ৬ থেকে ৭ শতাধিক পরিবারের জীবন ও জীবিকা। কারণ বড়শি বেয়েই চলছে তাদের জীবিকা। তাদের সাথে শিশুরাও মাছ শিকার করে। বেতাগী পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা এমনই দুই শিশু রাফসান ও সিয়াম, এরা বলেন, ‘সবার দেখাদেখি নেমে পড়েছি। মাঝে মধ্যে বড়শিতে ভাল পরিমানে মাছ পাই। বেশির ভাগ সময়ই চিড়িং মাছ ধরা পড়ে।

স্থানীয় জেলেরা জানায়, কয়েক বছর আগেও এখানকার খাল-বিল ও নদ-নদীতে পাঙ্গাস, শিলল, গাঁগড়া, রিটা, কাউন, পোয়া, আইড়, ফাহা, পাবদা, সরপুঁটি ও কোরালের মতো বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সচারচার পেতাম। এখন গলদা চিড়িং মাছ ছাড়া ওইসব মাছের দেখা মেলে কম।
সোহরাব হাওলাদারের মতো বেতাগী পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো: হেলাল ২নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ইলিয়াস, ১নং ওয়ার্ডর বাসিন্দা সাহেব আলী, একই ওয়ার্ডের শহিদুল ইসলাম, কনক, ৭ নং ওয়ার্ডর মেহেদী হাসান, রুবেলসহ উপজেলার বিবিচিনির বাড়ই খাল, বিবিচিনি খেয়াঘাট, ফুলতলা খাল, গাবুয়া খাল, ছোট ঝোপখালী, কেওয়াবুনিয়া, বেতাগী খাল,কেওড়াবুনিয়া, ঝিলবুনিয়া, ছোট মোকামিয়া খাল, মোকামিয়া লঞ্চঘাট, বেতাগী খালের স্লুইজগেট এলাকা, ফুলতলা, ঝোপখালী, ছোট মোকামিয়া, বড় মোকামিয়া জেলে ঘাট, কাঠালতলী, চরখালী, কইনার খাল, কাইয়ালঘাটা, গ্রামার্দ্দন খাল, ছোট বদনীখালী, বলাইবুনিয়া, তালবাড়ি, কালিকাবাড়ি, দক্ষিন কালিকাবাড়ি, জোমাদ্দার বাড়ীর হোতা ও নিবারণ বয়াতি এলাকা, আলীয়াবাদ, রাণীর খাল, গাবতলী খাল, ভোড়া খাল ও ফুলঝুড়ি এসব স্থানীয় খাল, বিষখালী নদী এবং বেড়েরদোন নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে বড়শিতে মাছ শিকারে সংসার চলে শত শত পরিবারের জীবন।

স্থানীয় মাছ শিকারিরা জানায়, তিথির পরিবর্তনে নদীর জোয়ার-ভাটার ধরনে বড়শিতে মাছ শিকারের কৌশলেরও পরিবর্তন করেন তারা। অবশ্য বর্ষায় বোয়াল, আইড়, কোরাল মাছ ধরা পড়ে। বড়শির আকার ও সুতার ধরনও থাকে ভিন্ন। আবার কার্তিক, পৌষ, মাঘ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত গলদা চিংড়ি, পোয়া, রিটা, গাঁগড়া ধরা পড়ায় এ সময় অনেকেই ডিঙ্গি নৌকায় ভেসে ছিপ বড়শি ফেলেন নদীতে। তারা বড়শির টোপে লালশো বা গেছে লাল পিঁপড়ের ডিম, এ্যাকাঙ্গি, মহুয়া ফুল, পুরনো মধু, মিষ্টির বাসি রস, আটাসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা ব্যবহার করে মাছ শিকার করেন। গলদা চিংড়ি ধরতে কেঁচোই ব্যবহার করেন অনেকে। তবে সময়ের পবিবর্তনে কাজের ধরন কিংবা মাছ ধরার কৌশল পরিবর্তন হলেও যেন পরিবর্তন নেই এদের জীবন-মানের। বড়শিতে বাঁধাই এদের জীবন-সংসার। এ সময়ে নদীতে গলদা চিংড়ি, আইড়, পোয়া, বোয়াল, পাঙ্গাস, কোরালসহ মিঠা পানির বিভিন্ন মাছের পাশাপাশি নদীতে ধরা পড়ছে।

স্থানীদেও সঙ্গে বিষখালী নদীর একাধিক পয়েন্টে বড়শিতে মাছ শিকারে এসেছেন বামনা, কাঠালিয়া, রাজাপুর, বাকেগরঞ্জ উপজেলার অনেক মাছ শিকারি। কাঠালিয়া উপজেলার শৌলজালিয়া গ্রামের সাহারুল খান ও মিলন দাস। তারা জানান, ২৫-৩০ বছর ধরে বড়শিতে মাছ শিকার করছেন তারা। বড়শিতে মাছ শিকার করেই ছেলে মেয়ের পড়াশুনার পাশাপাশি সংসার চলে তাদের। জমি-জমা না থাকায় ছোট থেকেই এই পেশায় জড়িয়ে আছেন তারা।

বেতাগী সরকারি কলেজের এইসএসসির পড়–য়া ছেলে কামরুল হাসানের লেখাপড়ার খরচ চলে বড়শিতে মাছ শিকারের টাকায়। বাবা আলতাফ হোসেন লেখাপড়া না জানলেও মাছ শিকারে ওস্তাদ। অনেকে প্রায়শই খালি হাতে ফিরলেও তার ডোল মাছে ভরে যায়। মাছ শিকার শেষে তা শহরে বিক্রি করেন। দৈনিক আয় তার ৪শত থেকে ৮শত টাকা কখনো আবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে বড়শিতে বড় মাছ পেলে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকাও আয় করেন তিনি।

তার মতো ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে বড়শিতে মাছ শিকারে এসেছেন কাজিরাবাদ ইউনিয়নের আব্দুর রাজ্জাক, তার ছেলে মো: শহীদুল মীর, মো: নিজাম, উপজেলার সড়িষামুড়ি ইউনিয়নের গাবতলী এলাকার আ: মোতালেব, ছেলে বেল্লাল হোসেন, আলীয়াবাদের মো: হানিফ, মো: আফজালসহ অর্ধশতাধিক মাছ শিকারি। বড়শিতে মাছ শিকার করেই চলে এদের প্রত্যেকের সংসার। আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কালের বিবর্তনে সবকিছু বদলে যাচ্ছে। চর জেগে নদী-খাল ভরাট হয়েছে। তাই আগের ন্যায় আর মাছও মেলেনা। তিনি আরও বলেন, ছেলে মেয়ের লেখাপড়া ও জীবিকার তাগিদে মাছ ধরি। জমি- জিরাত নেই। এ জন্য কষ্ট করে রাত জেগে নদীতে ভেসে মাছ শিকার করছি। বিষখালী নদীর মাঝ খানে জেগে ওঠা ছৈলার চরের শাখা খালে নৌকা নোঙ্গর করা পঞ্চার্ধো আব্দুর রহিম জানায়, পানির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। তবে বড়শিতে মাছ শিকারই তাদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। কিন্ত আগের সব মাছ যেন হারিয়ে গেছে, এখন আর নদী-খালে দেখা যায় না।

উপজেলার কালিকাবাড়ি এলাকার সোহেল মিয়া জানান, চরের অনেক কাঁকড়া শিকারিও এ সময় বড়শিতে মাছ শিকার করছেন। মাঘ ও ফাল্গুনে এদের অনেকে আবার বাগদার রেণুও ধরেন থাকেন। অবশ্য আগের তুলনায় আবহাওয়ার পরিবর্তন, রেণু পোনা নিধন, মা ইলিশ শিকার, নদী ভরাট, নিষিদ্ধজাল ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে নদীতে মাছ এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। শিকরির বড়শিতেও মিলছে না তেমন আর মাছ। ফলে কাটছে দুর্বিষহ জীবন এখানকার অনেক পরিবারের।

তবে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে যারা বেতাগী উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা ও বড়শিতে মাছ শিকারের সাথে জড়িত তাদের জেলে তালিকাভুক্ত করার মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা প্রয়োজন বলে দাবি করেন উপজেলার জেলে প্রতিনিধি ও মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রব সিকদার।

আরো পড়ুন

betagi

বেতাগীতে বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত 

মো. বশির উল্লাহ বাসার, বেতাগী প্রতিনিধি: বরগুনা জেলা বেতাগী উপজেলার কাজিরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় । বার্ষিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *