শুক্রবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৫

মানুষের বিশ্বাসের আলোকে বিপ্লবোত্তর সাংস্কৃতিক বন্দোবস্ত করতে হবে

আযাদ আলাউদ্দীন।।

জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূর্তি কবিতা উৎসব ও সেমিনারে আলোচকরা বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের আলোকে বিপ্লবোত্তর সাংস্কৃতিক বন্দোবস্ত করতে হবে। ভিনদেশি কোন সংস্কৃতি এদেশের জনগণ মেনে নেবেনা।
৩৩জুলাই তথা ০২ আগস্ট শনিবার সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার হলে কবিতা বাংলাদেশ আয়োজিত কবিতা উৎসব ও সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

কবিতা বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দেরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবিতা বাংলাদেশের সভাপতি কবি আল মুজাহিদী।

উৎসবের উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমদ খান।

বক্তব্য দেন কবি মাহবুব হাসান, কবি আশরাফ আল দীন, কবি জয়নুল আবেদীন আজাদ, কবি মোশাররফ হোসেন খান, কবি সোলায়মান আহসান, কবি হাসান আলীম, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, কবি শরীফ আবদুল গোফরান, কবি নাসির হেলাল, কবি ইব্রাহিম মণ্ডল প্রমুখ।

উদ্বোধনী পর্ব শেষে দ্বিতীয় পর্বে অনুষ্ঠিত হয় সেমিনার। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আবদুস সাত্তার।

প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডীন প্রফেসর ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান। আলোচক ছিলেন কবি জয়নুল আবেদীন আজাদ ও ড. ইয়াহইয়া মান্নান। সেমিনার পরিচালনা করেন নতুন মাত্রা সাহিত্য পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ড. ফজলুল হক তুহিন।

এছাড়াও কবিকণ্ঠে স্বরচিত কবিতা পাঠ অনুষ্ঠানের তিনটি পর্বে সারাদেশের তিন শতাধিক কবি কবিতা পাঠ করেন।
এসব পর্ব উপস্থাপন করেন কবি নাঈম আল ইসলাম মাহিন, তারিক হাসিব ও দিদার মুহাম্মদ।

‘জুলাই বিপ্লব ও নতুন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বন্দোবস্ত’ শীর্ষক কী নোট উপস্থাপন করেন কবি ও সাংবাদিক শাহীন হাসনাত।

তিনি তার প্রবন্ধে বলেন, ২০২৪ সালের ৩৬জুলাই বাংলাদেশে সংঘটিত ছাত্র-জনতার মিলিত সংগ্রামে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকা ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে। এই অভ্যুত্থান সরকারের পতন ঘটিয়েছে এবং একটি নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে, নতুন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বন্দোবস্তের ধারণাটিও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, যা একটি নতুন সাংস্কৃতিক নীতি, মূল্যবোধ এবং পরিচয়ের সন্ধান করে।

জুলাই অভ্যুত্থান, যা ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান’ বা ‘জুলাই বিপ্লব’ নামেও পরিচিত। মূলত এটি ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনের ফসল। ২০২৪ সালের ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৮ সালের কোটা সংক্রান্ত সার্কুলারকে অবৈধ ঘোষণা করার পর এই আন্দোলন আরও বেগবান হয়। এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে এই বিক্ষোভের বিষয়ে বেফাঁস মন্তব্য করেন এবং এর প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলন আরও তীব্র হয়।

জাতীয় সংস্কৃতি হল একটি সমাজের মানুষের জীবনযাপন প্রণালী, যার মধ্যে জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নৈতিকতা, আইন, প্রথা, এবং অন্যান্য অর্জিত অভ্যাস ও বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত। যা একটি সমাজের সদস্যদের মধ্যে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য এবং সমন্ময়ের মধ্যে স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। বাংলাদেশ একটি পাললিক বদ্বীপ; যা গড়ে উঠেছে নদী অববাহিকায়। সমতল থেকে শুরু করে সবুজ পাহাড়, তামাবিল থেকে সুন্দরবন, আমাদের রয়েছে বেশ কয়েকটি দ্বীপ ও বিস্তীর্ণ সমুদ্র তটরেখা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভূমি গঠনের বৈচিত্রের মতই এদেশে রয়েছে আরো কয়েকটি নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি। দেশের জনগণের বোধ-বিশ্বাস ও আকাঙ্খা অনুযায়ী সকল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা করবে। যাতে মূল্যবোধ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ এবং অধিকারভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র সুদৃঢ় হবে। সকল মানুষের মধ্যে সুকোমলবৃত্তি গড়ে উঠবে। মননশীলতার এই চর্চা মানুষের জ্ঞান, বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে সমৃদ্ধ করবে। শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক ও অন্যান্য সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে প্রকাশিত হবে। যা কিনা দেশের মানুষকে একটি সুস্থ সামাজিক, রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিক যাপন শৈলী গড়ে দিবে। আমাদের হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাস ও অনুস্মৃত ঐতিহ্য চর্চার মাধ্যমে আমাদের জাতীয় জীবনকে ঐক্যবদ্ধ রাখবে।

বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলতে বাঙালির বোধ-বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, খাদ্য, পোশাক এবং উৎসব ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই জনগণের ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। সকল সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক নিজস্বতা ও বৈচিত্র্যকে সমুন্নত রাখবে। জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্যবাহী উৎসব, লোককলা, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি জাতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাষ্ট্র এই জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষা ও প্রসারে দায় ও দরদের ভিত্তিতে নীতি ও কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে হবে।

জাতীয় সংস্কৃতির মূলনীতি হলো আমাদের জাতির আত্মপরিচয়, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের গৌরবকে জাতীয় আচরণে উন্নীত করা। জাতির মৌলিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য, এবং ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় ঐক্যকে সংহত করা। সমৃদ্ধ বাংলা সালতানাতের সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক গৌরব পুনরুদ্ধার ও পূনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকা। আমরা বিশ্বাস করি, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এই মানচিত্রের জনগণের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার ভিত্তিতে স্বাধীনতার আকাঙ্খা এবং জনসংগ্রাম থেকেই উৎসারিত। এর মূলভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা বিশ্বাসের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে তোলা। মুসলিম উম্মাহ কোনো কল্পনা নয়, বরং এটি একটি বাস্তবতা। মুসলিম উম্মাহ এক চূড়ান্ত রিসালাতের বার্তা, এক অনন্ত ওহীর শিক্ষা এবং এক দীপ্তিমান বিজয়ী সভ্যতার সিলসিলা। বাবা আদম শহীদ থেকে শুরু করে শাহ সুলতান বলখি, ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি থেকে শাহজালাল, খানজাহান আলী এই স্বদেশকে নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও মেহনতের মাধ্যমে তাওহিদের আলোয় নির্মাণ করেছেন। এখানকার জনগোষ্ঠী বহিরাগত হানাদার আর্যদের আক্রমণ প্রতিহত করে নিজেদের কলবকে তাওহিদের জজবায় সমৃদ্ধ করেছেন। এসবই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির মূল ভিত্তি ও শক্তির উৎস।

জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে এক নতুন আদিকল্পের (প্যারাডাইম) সম্ভাবনা হাজির করেছে। একুশ শতকে বাংলাদেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান (২০২৪) একটি মাইলফলক। চাকরিক্ষেত্রে কোটা সুবিধার যৌক্তিক সংস্কার, রাজনৈতিক অধিকার বাস্তবায়ন, বাকস্বাধীনতা পুনরুদ্ধার এবং পরিশেষে দীর্ঘ ১৫বছর ধরে চলা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানোর জন্য এটি একটি অমোঘ বাঁকবদল হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর, বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, একটি নতুন সাংস্কৃতিক বন্দোবস্তের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এই সাংস্কৃতিক বন্দোবস্তের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
স্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায়বিচার, এবং অসাম্প্রদায়িকতার মতো মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে একটি নতুন সাংস্কৃতিক কাঠামো গড়ে তোলা। বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার একটি পথ খুঁজে বের করা। সহিংসতা ও বিভেদের পরিবর্তে সহনশীলতা ও অন্তর্ভুক্তির সংস্কৃতি তৈরি করা। সকল মানুষের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই সমান সুযোগ পাবে। স্বাধীন মত প্রকাশ এবং সৃজনশীলতার বিকাশের জন্য একটি মুক্ত পরিবেশ তৈরি করা।

একটি নতুন সাংস্কৃতিক বন্দোবস্ত একটি সমাজের ভিত্তি স্থাপন করে। এটি মানুষের জীবনযাত্রা, মূল্যবোধ, এবং পারস্পরিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। একটি সঠিক সাংস্কৃতিক বন্দোবস্ত একটি স্থিতিশীল, প্রগতিশীল, এবং সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের পাটাতন নির্মান করবে। জুলাই অভ্যুত্থান এবং নতুন সাংস্কৃতিক বন্দোবস্ত একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। অভ্যুত্থান একটি পরিবর্তন ও সংস্কারের সুযোগ এনে দিয়েছে, যা একটি নতুন সাংস্কৃতিক আচরণ গড়ে দিবে। জনগণের বোধ-বিশ্বাসের ভিত্তিতে তৈরি এই নতুন বন্দোবস্তের মাধ্যমে একটি উন্নত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ে উঠতে পারে।

পুলিশ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সম্মিলিত হামলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যখন সবাইকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এসব হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। মেয়েদের হলের ভিতরে ঢুকে ছাত্রলীগসহ বহিরাগত সন্ত্রাসীরা বখাটেপনা করেছে। এই সব উন্মত্ততার ক্লিপস যেন হারিয়ে না যায়। ক্ষমতার দখলদারিত্বের পুরো মেয়াদে ফ্যাসিবাদ যে গণনিপীড়ন চালিয়েছে তা কিন্তু আমরা আমাদের গণসাহিত্যে আনতে পারিনি।

নোয়াখালী সুবর্ণচরে ডামি নির্বাচনের রাতে যে নারী লাঞ্ছনা হয়েছে সেটা নিয়ে কি কোন সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ হয়েছে? সূবর্ণচরের এমন ঘটনা তো সাতক্ষীরা, নীলফামারী আরো অনেক জায়গায় হয়েছে। এসব কি আমাদের গণসাহিত্যে এসেছে? ফোরাত তীরের কারবালার ট্রাজেডি, ভাগিরথি তীরের পলাশী ট্রাজেডি, মতিঝিলে শাপলা চত্বরের জেনোসাইড নিয়ে কি মহাকাব্য হতে পারেনা?

জুলাই বিপ্লবের চেতনা যাতে হারিয়ে না যায় এজন্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ডকুমেন্টারি, চলচ্চিত্র, নাটক নির্মাণ করতে হবে। গণসঙ্গীত লিখতে হবে। প্রেসক্লাব, বিশ্ববিদ্যলয় ক্যাম্পাস, উত্তরা, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, মীরপুর, মোহাম্মদপুর, চানখাঁরপুলসহ যেখানে যেখানে ম্যাসাকার হয়েছে প্রত্যেকটা স্থানে মনুমেন্ট গড়তে হবে। ঘটনার সচিত্র সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে বিলবোর্ড টাঙ্গায়ে রাখতে পারলে গণমানসে জুলাই বিপ্লব জাগরুক থাকবে।

মুসলমান প্রধান বাংলাদেশে জনগণের নিগূঢ় চৈতন্য হচ্ছে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস। আমরা মুসলমান। আমাদের তিন দিকেই উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে থাকবোনা বলেই ইসলামের কারণেই আমরা স্বতন্ত্র স্বদেশভূমি অর্জন করেছি। ইসলামই আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের একমাত্র রক্ষাকবচ। তাই তাওহিদই হবে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির মর্মবাণী। জাতীয় সাংস্কৃতিক নীতিমালার ভিত্তি হিসেবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের বিশ্বাস সমুন্নত রাখার প্রত্যয় আমাদের ‘জুলাই সনদ’ এ রাখতে হবে।

গুম হওয়া ব্যাক্তির স্বজনরা জানেনা অপহৃতদের কবে কোথায় খুন করে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে? কোথায় কবর? কত তারিখে মৃত্যু দিবস? কালেন্ডারের সবগুলো তারিখ তাদের কাছে অর্থহীন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী তরুণসমাজ সর্বাত্বক দ্রোহ ছড়িয়ে দিতে দেয়ালে দেয়ালে যেসব গ্রাফিতি এঁকেছিল কারা সেসব মুছে দিচ্ছে? যেসব কবি, সাহিত্যিক, ছড়াকার, শিল্পী, চিত্রকর, নট-নটি ফ্যাসিবাদের পক্ষে বৈধতা তৈরী করে দিত তাদের বিষয়ে কি ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়া হয়েছে তা অবশ্যই পর্যালোচনার দরকার আছে।

প্রতিটা বিপ্লবের পর তা বেহাত হয়ে যায় মূলত এই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের যে আকাঙ্খা ছিলো সেটা বিভিন্ন দল-গ্রুপের সংকীর্ণ স্বার্থন্মেষী মতলব চরিতার্থ করার কারণে। এর সঙ্গে থাকে উচ্ছেদকৃত শক্তির প্রতি অনুরক্তদের বর্ণচোরা কর্মসূচীর মাধ্যমে। এরা সবসময়ই পরবর্তীতে যাঁরা ক্ষমতায় যেতে পারে এমন রাজনৈতিক শক্তির ছাতার নিচে যেয়ে বিপ্লবের নৈতিক লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ায়।

ছায়ানট, উদীচী, প্রথম আলো, কয়েকটি টেলিভিশন এধরনের কর্মকান্ডে লিপ্ত। এসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান জুলাই বিপ্লবের বিরোধী ন্যারেটিভ তৈরী করছে। ফ্যাসিবাদের সফট পাওয়ার এখোনো কিভাবে নতুন নতুন কন্সপ্রেসি করে যাচ্ছে সেগুলোর জবাব দিতে আমরা কি ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মসূচি নেব সেগুলো আমাদের আলোচনায় আনা দরকার।

জুলাই বিপ্লবের পর নতুন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বন্দবোস্ত গড়তে সারাদেশের সকল কবি-লেখক, নঙ্গীত শিল্পী, চিত্রকর, অভিনয় শিল্পী সবাইকে নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে, বিভাগীয় শহরে, জেলায় জেলায় কনভেনশন করতে হবে। সীমান্তে তারকাটায় ফেলানীর লাশ নিয়ে আমরা কি করতে পেরেছি? পুশ ইন নিয়ে জননিপীড়ন চলছে এগুলো আমাদের গণসাহিত্যে এখোনো অনুল্লেখ রয়ে গেছে। কবিতা-গল্প-উপন্যাসে এসব জীবন কাহিনী আনতে পারলে এসব দেশবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে জনজাগরণ তৈরী হবে।

ঢাকা কে রাজধানী করে ১৯০৫ সালের বাংলা আসাম যে প্রশাসনিক বিন্যাস করা হয়েছিল এটা রদ করতে সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরামসহ যারা আগুনসন্ত্রাস করেছিল তারা হিন্দুত্ববাদের পূজারী। ওরা আমাদের বাংলাদেশ পন্থার শত্রু। মুন্সিগঞ্জের আদম শহীদ থেকে শুরু করে আহমদ শাহ বেরেলভি, সীপাহি বিপ্লবের হাবিলদার রজব আলী, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, মাহমুদুল হাসানের রেশমী রুমাল আন্দোলন, শরীয়তউল্লাহ, দুদুমিয়ার কৃষক আন্দোলন এসব নিয়ে কেন কোন চলচ্চিত্র বানানো হয়নি?

দিল্লীর আধিপত্যবাদ রুখতে মানসিংহের বিরুদ্ধে ঈশা খাঁর লড়াই নিয়ে দুর্দান্ত চলচ্চিত্র হতে পারে। আমরা বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালে ‘সুলতান সুলেমান’ ধরনের ডকুড্রামা দেখছি। কিন্তু আমাদের বাংলা সালতানাতের ঐশ্বর্য ও জৌলুশ কিন্তু এখনও আমাদের সিনেমা, নাটক, গল্প, উপন্যাস ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় আসে নাই। ভাটি বাংলার অনন্য শাসক মসনদে আলা ঈশা খাঁর তেজদীপ্ত শাসন, দিল্লীর আধিপত্যবাদ প্রতিহত করতে সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহকে পরাস্থ করতে যে অনন্য লড়াই তা বর্তমান আঞ্চলিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের হিম্মত যোগাবে। এ লক্ষ্যে ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর ‘রায় নন্দিনী’ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ খুবই প্রয়োজন। শফিউদ্দিন সরদারে লেখা ‘গৌড় থেকে সোনারগাঁ’ উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র হওয়া দরকার। মহান মুক্তিযুদ্ধের নির্মোহ চিত্রায়নে কবি আল মাহমুদের ‘কাবিলের বোন’ হতে পারে অনবদ্য সিনেমা।

দেশের ইতিহাস নিয়ে লিখতে গিয়েও আওয়ামী লীগের রোষানলে পড়তে হয়েছে। আদালতের আদেশে হুমায়ূন আহমেদের ‘দয়াল’ উপন্যাসের বিকৃতি ঘটাতে হয়েছে। এসব নিয়ে লিখকদের যেভাবে প্রতিবাদ করা উচিত ছিলো আমরা তা করতে পারিনি। তথ্যসন্ত্রাস হচ্ছে মূলত অপতথ্য। আঁধার দিয়ে আঁধার ঘোচানো যায়না। আঁধার তাড়াতে আলো জ্বালাতে হয়। ওরা বলেছিল, বাংলাদেশ সিরিয়া হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ সিরিয়া হয়নি বরং সিরিয়া বাংলাদেশ হয়ে গেছে। আমাদের গণমাধ্যমগুলোর নির্বাহীর আসনে ফ্যাসিবাদের লেসপান্সারদের সরাতে না পারলে সত্যস্বর নির্মাণ সম্ভব হবেনা। কর্পোরেট হাউজ আমাদের নতুন চ্যালেঞ্জ। কর্পোরেট হাউজের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে শতমুখে মিথ্যাচার ও ঘটনার আংশিক প্রচারে সত্য ধ্বনি কেবলই নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। গুম-খুন-সাজানো মামলায় ফাঁসি, গণনির্যাতন, গণহত্যা,গণলুন্ঠন এসব ঘটনার বিশদ তথ্য ও বর্ণনা কেন গণমাধ্যমে আসেনি। কারণ গণমাধ্যমগুলোয় যাঁরা আছেন তাঁরা হয় এসব ঘটনার বৈধতা উৎপাদনে ভূমিকা রেখেছে কিংবা ফ্যাসিবাদের ঝুঁকি এড়াতে এসব বিষয়ে তাঁদের প্রায়োরিটি নেই।

ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘দশকের পর দশক ধরে কিছুই ঘটে না, আবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দশকের ঘটনা ঘটে যায়।’ ঠিক এটাই ঘটেছে আমাদের কয়েক সপ্তাহের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশের নয়া সাংস্কৃতিক বন্দবোস্ত কি হবে এবিষয়ে সংস্কৃতি কর্মীদের ভাবতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস মান বলেছেন, রাজনীতি হচ্ছে বিধিলিপি। জনগণ কেমন জীবন যাপন করবে রাজনীতিকরাই তার নকশা নির্ধারণ করেন। আমাদের দেশেও সংস্কৃতি কর্মীরা রাজনীতিকদের নকশার আদলে আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মসূচী দিয়ে থাকেন যা কিনা খুবই দুঃখজনক।

মূলত, জাতীয় সাংস্কৃতিক নীতিমালা ছাড়া আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় ও রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যাবেনা। প্রতিটা জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। এটি গড়ে ওঠে জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়, বৃহত্তর অংশের বোধ-বিশ্বাস, ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকজ চৈতণ্য, জাতীয়মুক্তির লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত সাংস্কৃতিক আচরণ ও সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে। জুলাই সনদ হতে পারে গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ জুলাই সনদ একটি রাজনৈতিক চুক্তি। দ্বন্দ্বময় এক বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গণআকাক্সক্ষা, প্রতিরোধ বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাকে সুদৃঢ় ভিত্তি দিতে জুলাই সনদে উপরিউক্ত বিষয়গুলোর অন্তর্ভূক্তি অপরিহার্য। তাই বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে জুলাই অভ্যুত্থান তুলে ধরতে নাগরিক হিসেবে সকলেরই দায় আছে। গণসঙ্গীত, কবিতা আবৃত্তি ও নাটক প্রদর্শনী এসবের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী চেতনা ও ইনসাফের মর্মবাণী ফুটিয়ে তুলতে হবে।

শেষ কথা হচ্ছে, সব স্বৈরশাসকই তার শাসনের নিগড়ে জনগণকে আবদ্ধ রাখতে নিজস্ব চেতনার গল্প শোনায়। দলীয় শ্রেষ্ঠত্বের হেজিমনি তৈরী করে। ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্মূল করতে পক্ষ-বিপক্ষের ন্যারেটিভ তৈরী করে। এক্ষেত্রে প্রজন্মের কাছে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে একটি হেরিটেজ মিউজিয়াম গড়ে তুলতে হবে। যেখানে থাকবে আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় নৃতাত্বিক পরিচয়ের ধারাক্রম ভাষাভিত্তিক পরিচয়ের নির্মান ও বিকাশ পর্ব। জাতির রাজনৈতিক ইতিহাস। সাংস্কৃতিক বিকাশের পরাম্পরার তথ্যচিত্র। যে কেউই হেরিটেজ মিউজিয়াম পরিদর্শনের মাধ্যমে জানতে পারবে বাংলা সালতানাতের সকল পর্ব। আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের মূলধারার আখ্যান মেলে ধরা হবে ‘এ্যাজ ইট ইজ’ আকারে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আজ নতুন বংলাদেশ গড়তে সাংস্কৃতিক বন্দবোস্ত নির্মাণের যে সুযোগের দরোজা উন্মোচন হয়েছে সেটা যেন গাফলত আর খেয়ালের ভুলে হারিয়ে না যায় এই হোক আজকের অঙ্গীকার।

আরো পড়ুন

‎গৌরনদীতে অজ্ঞাত পরিবহনের ধাক্কায় নিহত-১

সোলায়মান তুহিন গৌরনদী প্রতিনিধি।। ‎বরিশাল–ঢাকা মহাসড়কের গৌরনদী উপজেলার সাউদের খালপার এলাকায় দ্রুতগামী অজ্ঞাত পরিবহনের ধাক্কায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *