বরগুনা প্রতিনিধি
বরগুনার পায়রা, বিষখালী এবং বলেশ্বর নদীর ভয়াবহ তীরভাঙনের কারণে উপকূলজুড়ে নীরব বিপর্যয় নেমে এসেছে। প্রতিদিন নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ঘর-বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষিজমি, বাজার ও যোগাযোগব্যবস্থা। ভাঙন আতঙ্কে লক্ষাধিক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। কারো মাথার উপর ছাদ নেই, কারো জীবন-জীবিকার পথ রুদ্ধ।
গত কয়েক বছর ধরে পাউবো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করলেও নদীর তীব্র স্রোত ও ভৌগোলিক পরিবর্তনে সেই বাঁধগুলোও টেকসই হচ্ছে না। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বহুবার প্রতিরক্ষা নির্মাণের পরেও নদীকে থামানো সম্ভব হয়নি। বাঁধের লাইন তিনবার পরিবর্তন হলো, তবুও নদীকে থামানো গেল না! এরকম ক্ষোভ প্রকাশ করছেন স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে।
ভাঙনের প্রধান কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞ মহল সূত্রে জানা গেছে, বর্ষাকালে পানি চাপ বৃদ্ধি, অবৈধ দখল, বাধাগ্রস্ত পানিপ্রবাহ, ইটভাটা ও চর দখল, বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টিও নদীভাঙনকে তীব্রতর করছে।
অব্যাহত নদী ভাঙ্গনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হচ্ছে পায়রা ও বলেশ্বর নদীর তীরবর্তী বরগুনা সদরের বালিয়াতলী, তেঁতুলবাড়িয়া, বুড়িরচর, গোলবুনিয়া, রায়ের তবক, নলটোনা, আজগরকাঠি, ডালভাঙ্গা, নলী বন্দর; পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা, জিনতলা, রুহিতা, কাকচিড়া; বামনা উপজেলার রামনা; বেতাগী উপজেলার সরিষামুড়ি, কালিকাবাড়ী, হোসনাবাদ, মোকামিয়া; আমতলী উপজেলার বালিয়াতলী, গুলিশাখালী, পচাকোড়ালিয়া, আরপাঙ্গাশিয়া, যোপখালী; তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া, চরপাড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকা।
বরগুনার সদর উপজেলার ১০নং নলটোনা ইউনিয়নের নলটোনা গ্রামের চিত্র খুবই ভয়ংকর। আগ্রাসী বিষখালী নদীর ভাঙ্গনে অসহায় হয়ে পড়েছে এখানকার মানুষগুলো। হারাচ্ছে ফসলী জমি, নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন জীবিকা। বড় বড় বাড়িগুলো ভাঙ্গনের কবলে ছুঁই ছুঁই অবস্থা। ইতোমধ্যেই অনেকে বসতভিটা, ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে এলাকা ত্যাগ করেছেন। প্রয়োজন পানি উন্নয়ন বোর্ডের শক্ত পদক্ষেপ। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হলে এসব এলাকা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মুহূর্তের মধ্যে।
বিপদসংকুল এই এলাকার মানুষ সেলিম শাহনেওয়াজ চোখভরা পানি নিয়ে বলেন,পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে হাতজোড় করে বহুবার অনুরোধ করছি- শীঘ্রই এই এলাকার মানুষ এবং তাদের ফসলি জমি ও বসতবাড়ি রক্ষা করুন। কিন্তু কেউ শোনে না আমাদের আকুতি।
নদী ভাঙ্গনের শিকার তালতলীর মিশনবাড়িয়া গ্রামের আব্দুল জব্বার হাওলাদার বললেন, গত বছর যে মাঠে বীজ ফেলেছি, আজ সেখানে নদীর ঢেউ খেলছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে গৃহহীন হাজারো মানুষ, কৃষিজমি নদীতে বিলীন, জীবিকা সংকটে অসংখ্য পরিবার। বিদ্যালয়-সড়ক ধ্বংসে থমকে গেছে শিক্ষা ও যোগাযোগব্যবস্থা আশ্রয়হীন মানুষের ভরসা এখন শুধুই দুর্ভোগ।
ষাটোর্ধ্ব আব্দুল খালেকের চোখে পানি। তিনি বলেন, নদী আর এক দফা নিলে আমরা থাকার জায়গাটুকুও হারাবো। ধীরগতিতে বাত সংস্কারের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় স্থানীয়দের ক্ষোভের কোন অন্ত নেই। পাউবো সূত্রে জানা যায়—জেলার ৮৫০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ৫০০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু সংস্কার চলছে মাত্র ৩০০ কিলোমিটারে। বাকি ২০০ কিলোমিটারও ঝুঁকির মুখে।
অমাবস্যা-পূর্ণিমার সময় এসব ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে প্লাবিত হয় নিম্নাঞ্চল; নষ্ট হয় মাছের ঘের, ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি। নিশানবাড়িয়া এলাকায় বসবাসকারী মো. জাফর হোসেন বললেন- স্কুল-কবরস্থান-হাটবাজারও টিকছে না। এখন সবকিছুই নদীর গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়।
তালতলীর চরপাড়ার নিজাম উদ্দিনের কণ্ঠে হতাশা। তিনি বলেন, আরেক দফা ভাঙন হলে আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে যাব। বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব বলেন, নদীভাঙন রোধে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে কাজ চলছে। স্থায়ী সুরক্ষা ব্যবস্থার জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দের অপেক্ষায় আছি।
তবে স্থানীয়দের দাবি-কাগজে প্রকল্প আছে, কিন্তু বাস্তবে রক্ষাব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশের উপকূলকে রক্ষা করতে হলে টেকসই নদী ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু অভিযোজন, দখলমুক্ত নদী প্রবাহ ও কার্যকর বাঁধ নির্মাণ জরুরি। বরগুনার মানুষের আর্তনাদ- সরকার যদি এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়, মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যাবে বহু জনপদ।
Daily Bangladesh Bani বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দৈনিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের প্রচার করি।