ভোলা প্রতিনিধি
ভোলার একটি বিচ্ছিন্ন চর দৌলতখানের নেয়ামতপুর চর। এ চরে ডাকাতদের রাজত্ব চলে বলে মনে করছে স্থানীয়রা, নিরাপত্তা হীনতায় চরের বাসিন্দারা। এ চরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন। চর দখলকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে লাঠিয়াল বাহিনী ও ডাকাতদের অস্ত্রের মহড়া, হামলা, লুটপাট, ছিনতাই ও জমি দখলের মতো ঘটনা এখানে প্রতিদিনই ঘটছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চরে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হলেও তেমন একটা সুফল পাচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এলাকাবাসীর মধ্যে এখনো ফেরেনি স্বস্তি। উল্টো অভিযোগ উঠেছে পুলিশের উপস্থিতিতেই হামলা ও ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটছে। চরের জমি এবং নিরাপত্তার দাবিতে মানববন্ধন করেছেন চরবাসী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ৩ দশক আগে ভোলার দৌলতখান উপজেলার বিচ্ছিন্ন নেয়ামতপুরের মেঘনার বুকে জেগে এই চর। বিস্তীর্ণ চরে এখন কয়েক হাজার মানুষের বসবাস। এখানকার মানুষ কৃষিকাজ, পশুপালন ও মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। উর্বর মাটির কারণে এখানকার কৃষকরা তরমুজ, ধান, দেশি সবজি, এমনকি বিদেশি ফসল ক্যাপসিকামও চাষ করেন। ফলনও তুলনামূলক ভালো। মেঘনার বুকে জেগে ওঠা সবুজে ছেয়ে যাওয়া এই চর দেখতে খুবই শান্ত হলেও এখানকার মানুষের দিন কাটে চরম আতঙ্কে। ভোলার এই চরে কৃষিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হলেও বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে লাঠিয়াল আর ডাকাত বাহিনীর আতঙ্ক। স্থানীয়রা বলছেন, প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে লাঠিয়াল বাহিনী ও ডাকাত গ্রুপ চাষাবাদে বাঁধা দিচ্ছে। জমি দখলের উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত হামলা চালানো হচ্ছে।
কথা হয় চরের এক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সঙ্গে। নাম জানালেন বারেক ভুলাই। তিনি বললেন, ধান রোপণ করলে রাতে এসে কেটে নিয়ে যায়। গরু-ছাগলও নিয়ে যায়। পুলিশের সামনেই মহড়া দেয়, যেন কারও কিছু বলার নেই।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলা থেকে এই চরে চাষাবাদ করতে এসেছেন রাসেল মিয়া। নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া তিক্ত অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, বাড়িতে লালন-পালন করা গরু-ছাগল বিক্রি করে ও জমি বর্গা দিয়ে ১ লাখের মতো টাকা সংগ্রহ করি। পরিকল্পনা ছিল এই চরে তরমুজ চাষ করব। কিন্তু দুই-এক দিন পর পর দৌলতখান থেকে একদল ডাকাত এসে আমাদের মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। বাঁধা দিলে তারা হামলা চালায়।
চরের আরেক বাসিন্দা আবদুল মালেক বলেন, পারিবারিকভাবে পাওয়া জমিতে আমরা চাষ করতে পারছি না। দিন-রাত আতঙ্কে থাকতে হয়। প্রতিবাদ করলে হুমকি দেয়, বাড়িঘর ভেঙে দেয়। রোজিনা বেগম নামে এক অভিভাবক বলেন, মেয়েদের ঘর থেকে একা বের হতে দিই না। ডাকাতদের ভয়ে সন্ধ্যার পর পুরো চর নীরব হয়ে যায়। চরের বাসিন্দারা জানান, তারা জমি নিয়ে উচ্চ আদালত থেকে একাধিকবার রায় পেয়েছেন, কিন্তু প্রভাবশালী মহলের লাঠিয়াল বাহিনী আদালতের ওই রায় না মেনে জোর করে জমি দখল করে যাচ্ছে।
স্থানীয় সমাজকর্মী শাহাবুদ্দিন বললেন, উচ্চ আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও লাঠিয়াল বাহিনীর হাত থেকে নিস্তার মিলছে না। পুলিশও তেমন কিছু করে না। এ জন্যই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বাড়ছে।
চরের বিভিন্ন অংশ ঘুরে জানা যায়, মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এ চরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এ ছাড়া নদীভাঙনের কারণে যাতায়াত ব্যবস্থাও সহজ নয়। এমন অবস্থায় পুলিশের নিয়মিত টহলও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে লাঠিয়াল বাহিনী সুযোগ বুঝে হামলা চালিয়ে জমি দখল করে নিচ্ছে। এছাড়া দৌলতখানের একদল ডাকাত এসে লুটপাট চালায়।
তবে গণমাধ্যমকর্মীর সামনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এমন আশ্বাস থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। ডাকাতদল ওই চরে ২৯ নভেম্বর বেলা ৩টার দিকে নেয়ামতপুর পুলিশ ক্যাম্পের পাশেই ডাকাতদল কৃষকদের ওপর হামলা চালায়। মুহুর্মুহু গুলি ও ককটেল ফোটানো হয়। বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে লুটপাট করা হয়। পুলিশের উপস্থিতিতে হামলা-লুটপাটের বিষয়ে জানতে চাইলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা এসআই মো: শাহীন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অপরদিকে জমি রক্ষা এবং নিরাপত্তার দাবিতে শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) মেঘনার বুকে জেগে ওঠা ওই চরের কয়েক হাজার মানুষ নদীর পাড়ে জড়ো হয়ে তাঁরা মানববন্ধনে অংশ নিয়ে এর প্রতিকার চান। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন দৌলতখান পৌর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো: বশির আহমেদ, জমির মালিকানা দাবিদার মো: সেলিমসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। এ সময় সেলিম জানান, গত ২ ডিসেম্বর দুপুরে হঠাৎ করে চরে হামলা ও গুলি বর্ষণ করে ভূমিদস্যু সকেট জামাল ও বশির হাওলাদারের বাহিনী। এতে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি চরের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা জোরালো করার দাবি জানান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নেয়ামতপুর পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই সুবীর সাহা অবশ্য নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইলেন। তিনি বলেন, চরে নিয়মিত টহল দেওয়া হয়। যে কোনো অনিয়ম হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর-দৌলতখান সার্কেল) মো: ইব্রাহিম বলেন, চরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। দখল বা হামলার ঘটনা জানতে পারলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Daily Bangladesh Bani বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দৈনিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের প্রচার করি।