খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী ।।
বিখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী Samuel P. Huntington Quote এর লেখা ‘The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order এর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের লেখাটা শুরু করি। লেখক তার লেখায় সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজী নিয়ে লিখতে গিয়ে এভাবে লিখেছেন-
“The great divisions among humankind and the dominating source of conflict will be cultural… The fault lines between civilizations will be the battle lines of the future.”
জনাব তারেক রহমান বাংলাদেশের মানুষ আজ আপনাকে প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূসের পরবর্তী ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। এটা নিঃসন্দেহে আপনার এবং আপনার দলের সুনাম সুখ্যাতিকে অনেক উপরে উঠিয়ে দিচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ভয়াবহ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বিগত বছরগুলোতে—চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস আর দখলদারিত্ব। আর দুঃখজনক হলেও সত্য বিগত শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পরে , এই অপরাধমূলক সংস্কৃতির বড় একটি অংশ পরিচালিত হচ্ছে বিএনপির কিছু নেতাকর্মীর হাতে। হ্যাঁ, আমরা বলছি আপনাদের কথা, তারেক রহমান সাহেব। আপনার দলের কতিপয় প্রথম সাড়ির নেতাদের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা একদল বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের রাজনৈতিক কর্মী পরিচয়ে অসাধু ও সন্ত্রাসীদের বর্তমান কার্যকলাপ আজ জনগণের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
রাজনীতির নামে সন্ত্রাস, দলীয় ক্ষমতা দেখিয়ে চাঁদা আদায়, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে হামলা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখল, স্থানীয় পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তার—এসব যেন বিএনপির ‘স্ট্র্যাটেজি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনী মাঠে হোক বা আন্দোলনের ব্যানারে—আপনাদের অনেক কর্মী এখন শুধু রাজনীতি নয়, নানান ধরনের অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছে।
চাঁদাবাজি এখন বিএনপির তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত এক নীরব স্বীকৃত ‘তহবিল সংগ্রহের কৌশল’। রাজনৈতিক পরিচয়ে ইজারা বাণিজ্য, বাজার দখল, ঠিকাদারিতে হস্তক্ষেপ—এসবই চালু আছে দলের কর্মীদের হাতে। যারা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তারা হামলার শিকার হয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এই কি আসলে কোন রাজনৈতিক আদর্শ?
সন্ত্রাস আর দখলবাজির রাজনীতির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিকটি হলো, এটি সাধারণ মানুষকে রাজনীতিবিমুখ করে তোলে এবং জনমনে ভীতির সৃষ্টি করে। জনগণ যখন দেখে যে রাজনৈতিক কর্মী পরিচয়ে কেউ জোর করে ঘর-বাড়ি দখল করছে, কৃষকের জমি কেড়ে নিচ্ছে, শিক্ষার্থীকে নির্বিচারে মেরে ফেলা হচ্ছে—তখন তারা সেই রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
আর এই অরাজকতা দিনের পর দিন চলতে পারে না। আপনি তো দেশের বাইরে বসে রাজনীতি করছেন বিগত বহু বছর ধরে।সাধারণ মানুষের মাঝে আপনার গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই তুঙ্গে। আপনার একটি বড় পরিচয় রয়েছে আপনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরী। কিন্তু আপনার নামেই মাঠে নেমে অনেকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। আপনি কি দেখেন না? আপনি কি শুনেন না—আপনার দলের নাম ভাঙিয়ে একজন দিনমজুরের শেষ সম্বলটি দখল করে নেওয়া হচ্ছে?
আপনার দলের আন্দোলন যদি সত্যিই গণতন্ত্রের জন্য হয়, তাহলে সেই আন্দোলনের ন্যূনতম শর্ত হচ্ছে নৈতিকতা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই মুহূর্তে বিএনপির আন্দোলনের মাঠে আছে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ আর অস্ত্রের ঝনঝনানি। আপনার কর্মীদের মুখে আছে ‘গণতন্ত্র রক্ষার’ বুলি, কিন্তু হাতে আছে রড-লাঠি-বন্দুক।
আপনার নেতৃত্বাধীন বিএনপি কি একবারও ভেবে দেখেছে, এই সহিংস চেহারা দেখে মানুষ আপনাদের কতটা বিশ্বাস করে? গণতন্ত্র মানে তো জনগণের আস্থা, তাদের সঙ্গে থাকা,সাধারণ দেখভাল করা। অথচ আপনার দলের কিছু কর্মী এখন জনগণের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। তারা বিএনপিকে ও জনগণকে মুখোমুখি কতৃপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর মত কাজকর্ম করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আপনার ছাত্রসংগঠন বারবার সহিংসতার জন্য অভিযুক্ত। তারা হল দখল করে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করে, অস্ত্রের ঝনঝনানিতে শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস করে। এই সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে আপনি উৎসাহিত করছেন না?
সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং আস্থা রেখেই বলছি আপনি এখনো যদি এদের থামাতে না পারেন, তাহলে আপনার নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আর যদি আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে এদের প্রশ্রয় দেন, তাহলে ইতিহাস আপনাকে একজন অপরাধের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মনে রাখবে—একজন দায়িত্বহীন নেতা হিসেবে, যিনি নিজের দলের ভেতরের অপরাধীদের শাসন না করে বরং তাদের ব্যবহার করেছেন নিজের স্বার্থে।
বিগত সময় গুলোর মত বাংলাদেশে আরেকটা রাজনৈতিক সন্ত্রাসের দশক আমরা চাই না। জনগণ ক্লান্ত, অতিষ্ঠ, বিরক্ত ও রাজনীতি বিমুখ। তারা পরিবর্তন চায়, কিন্তু সেই পরিবর্তনের নামে নতুন করে চাঁদাবাজ, দখলবাজ ও সন্ত্রাসীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে প্রস্তুত নয়।
এই মুহূর্তে আপনার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে—আপনার কর্মীদের থামানো,তাদেরকে আদর্শিক, নৈতিক ও পরিমার্জিত রাজনীতির অনুশীলন করান। তাদের বলুন, রাজনীতি মানুষের সেবা করার জন্য, রাজনীতি মানুষের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার জন্য, রাজনীতি মানুষের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার জন্য, দখলদারি করার জন্য নয়। তাদের শিখিয়ে দিন, গণতন্ত্র গড়তে হলে জনগণের হৃদয় জয় করতে হয়, জনগণের গলায় গলায় ভাব করতে হয়, গলায় ছুরি ঠেকিয়ে নয়।
রাজনীতি হোক নীতি আর আদর্শের মঞ্চে, মাদক, চাঁদাবাজ অপরাধ আর দখলের নাট্যমঞ্চে নয়। এখনো সময় আছে—নিজেদের ঠিক করে নেওয়ার, না হলে জনগণই একদিন চূড়ান্ত জবাব দেবে, যা কখনো আমাদের কাম্য নয়।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা
Daily Bangladesh Bani বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দৈনিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের প্রচার করি।