শুক্রবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৫

সামাজিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ- খাজা নাছের আলী (রহ:) এর শিক্ষাদর্শন ও সমাজিক ভাবনা

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী।। 

আজকের সমাজে যখন শিক্ষা বলতে অধিকাংশ মানুষ বোঝে সার্টিফিকেট, চাকরি, পদ-পদবি, কিংবা বিদেশী ডিগ্রি—তখন প্রশ্ন জাগে, “এই শিক্ষা কি আমাদের বিবেকবান করে তুলছে?” শিক্ষা কি আমাদের সমাজে সহমর্মিতা, ন্যায়, মানবিকতা ও নৈতিকতা সৃষ্টি করতে পারছে?
এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে গিয়ে আমারা একজন আধ্যাত্মিক সাধক ও দিব্যজ্ঞানী পুরুষের কথা উল্লেখ করা যায়—১৮০০ শতকের শেষভাগে জন্ম নেওয়া নবাব পরিবারের আধ্যাত্মিক সাধক ও শিক্ষানুরাগী খাজা নাছের আলী (রহঃ), যিনি শিক্ষাকে শুধু জ্ঞান অর্জনের উপকরণ হিসেবে দেখেননি, বরং সমাজ পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে দেখেছেন। তার বুজুর্গ পিতাও হযরত শাহ সুফি খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:) প্রকৃতপক্ষে একজন স্বশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। তাঁর মতে, প্রকৃত শিক্ষা হলো হৃদয়ের শিক্ষা—যা মানুষকে মানবিক, নৈতিক এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি দায়বদ্ধ করে তোলে।

শিক্ষা বিষয়ক প্রচলিত বিভ্রান্তি: সমাজে শিক্ষাকে ঘিরে একধরনের সামাজিক মোহ কাজ করে। অনেকেই মনে করেন, বিদেশি ডিগ্রি, উচ্চপদস্থ চাকরি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা মানেই “শিক্ষিত” হওয়া। অথচ এই তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের অনেকেই জীবনের মৌলিক নৈতিকতা, মানবতা কিংবা দায়বদ্ধতার চর্চায় চরমভাবে ব্যর্থ।
শুধু তথ্যভিত্তিক শিক্ষা বা “বুকিস্ট নলেজ” সমাজে পরিবর্তন আনে না, যদি না সেই জ্ঞান মূল্যবোধ ও আত্মিক অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত হয়।

খাজা নাছের আলী (রহঃ)-এর মতে প্রকৃত শিক্ষা দুটি স্তম্ভে গঠিত:

১. বুদ্ধিগত শিক্ষা (Intellectual Education): এটি মস্তিষ্কে জ্ঞান জোগায়। এটি পাঠ্যবই, পরীক্ষা, সার্টিফিকেট, কর্মজীবনে প্রয়োগযোগ্য তথ্য, হিসাব-নিকাশ, বিজ্ঞানের সূত্র ইত্যাদি শেখায়।
২. মূল্যবোধনির্ভর শিক্ষা (Value-Based Education): এটি হৃদয়কে উর্বর করে। এটি আমাদের মধ্যে সহমর্মিতা, সততা, দায়িত্ববোধ, ত্যাগ, পরোপকার ও সত্যবাদিতা সৃষ্টি করে। এই শিক্ষা মানুষকে তার নিজস্ব আত্মা ও বিবেকের সঙ্গে পরিচিত করে এবং একটি নৈতিক সমাজ নির্মাণে সহায়তা করে। এই দ্বিতীয় ধরণের শিক্ষাকেই খাজা নাছের আলী (রহঃ) “প্রকৃত শিক্ষা” বলে অভিহিত করেছেন।

খাজা নাছের আলীর (রহ:) শিক্ষাদর্শনের উৎস ও প্রয়োগ: হযরত মৌলভী খাজা নাছের আলী (রহঃ) নবাব পরিবারের সন্তান হলেও খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তিনি বুঝতেন যে প্রাসাদে থেকে সমাজের বাস্তব চিত্র অনুধাবন করা যায় না। এজন্যই তিনি সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের অভিজ্ঞতা, দুঃখ-কষ্ট ও চাহিদা উপলব্ধি করতেন। তিনি গ্রামে-গঞ্জে, মক্তবে-মাদ্রাসায়,খানকায় এমন একধরনের শিক্ষা চর্চা চালু করেছিলেন, যেখানে ছাত্রকে কেবল পড়া মুখস্থ করানো হতো না, বরং তার মধ্যে আত্মসংযম, শিষ্টাচার, সত্যনিষ্ঠা ও আল্লাহর ভয় জাগ্রত করার শিক্ষা দেওয়া হতো।
বিভক্ত সমাজে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার গুরুত্ব: আজকের সমাজে শিক্ষিত মানুষ সংখ্যা বাড়লেও, সামাজিক সংহতি ও নৈতিক শক্তি কমে যাচ্ছে। খাজা নাছের আলী (রহঃ) বলতেন, “প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এক ধরণের ‘স্রষ্টাবৃত্তি’ থাকে। কিন্তু সেটি জাগ্রত করতে হয় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা দিয়ে।”

তিনি সমাজে ধর্ম, বর্ণ, দল, মত কিংবা শ্রেণিভেদ ভুলে সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে, প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে বিভক্ত করে না, বরং মানুষকে একটি বৃহৎ মানবিক পরিচয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করে।

আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় খাজা নাছের আলী (রহ:) এর দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা: জাতিসংঘের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংস্থা UNESCO ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, “Future education must be more human-centric, emphasizing empathy, ethics, and equity.” অর্থাৎ ভবিষ্যতের শিক্ষা হবে মানবিকতা নির্ভর, যেখানে সহানুভূতি ও নৈতিকতা প্রধান ভূমিকা রাখবে। খাজা নাছের আলী (রহ:) এর শতবর্ষ পুরাতন শিক্ষা-দর্শন আজকের পৃথিবীর এই চাহিদার সঙ্গে সম্পূর্ণ সামনজস্যপূর্ণ। অথচ আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে এই নৈতিক শিক্ষা খুবই নগণ্যভাবে উপস্থিত।

স্বার্থপরতা বনাম আত্মত্যাগের শিক্ষা: বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে- “আমি কীভাবে উন্নতি করবো” সেই চিন্তায় ব্যস্ত রাখে। সেখানে খাজা নাছের আলী (রহঃ) শিক্ষা দিতেন, “তুমি কিভাবে সমাজের জন্য উপকারি হতে পারো”। এটাই প্রকৃত শিক্ষা—যা আত্মসর্বস্ব নয়, বরং পরার্থপর।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবনা: স্কুল-কলেজে মূল্যবোধ ভিত্তিক পাঠ্যক্রম সংযোজন করা উচিত,

  • ১.যেখানে সত্যবাদিতা, করুণা, পরিবেশ-সচেতনতা, আত্মশুদ্ধি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ শেখানো হবে।
  • ২.ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদদের অংশগ্রহণে মূল্যবোধের শিক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। খাজা নাছের আলীর মতো আলোকিত মানুষদের জীবন ও দর্শন নিয়ে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন হতে পারে।
  • ৩. শিক্ষিত সমাজের দায়িত্বশীলতা পুনঃনির্ধারণ করতে হবে, যাতে ডিগ্রিধারী মানেই মানবিক মানুষ হয়—এমন একটি মানদণ্ড তৈরি করা সম্ভব হয়।
    শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য কোথায়?: শিক্ষা কোনো সার্টিফিকেট নয়, শিক্ষা একটি আত্মজাগরণের প্রক্রিয়া। এটি মানুষকে মানুষ করে তোলে। খাজা নাছের আলী (রহঃ)-এর শিক্ষাদর্শন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যে শিক্ষার মধ্যে স্রষ্টার প্রতি দায়িত্ব, সৃষ্টির প্রতি দয়া ও নিজের প্রতি আত্ম-শুদ্ধির প্রয়াস নেই, সে শিক্ষা অসম্পূর্ণ।

আজ যখন আমরা দুর্নীতি, সামাজিক ভাঙন, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও মানবিক সংকটে জর্জরিত; তখন খাজা নাছের আলী (রহ:) এর মতো আধ্যাত্মিক শিক্ষানুরাগীদের দর্শন আমাদের সামনে আলোর দিশা দেখাতে পারে।

লেখকঃ সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা

আরো পড়ুন

বাবুগঞ্জের ইউএনও’র বদলি স্থগিতের দাবিতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে মানববন্ধন

বাবুগঞ্জ প্রতিনিধি।। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার জনপ্রিয়, জনবান্ধব ও মানবিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারুক আহমেদের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *