খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী।।
জগৎ বিখ্যাত আলেম, মারেফতের উঁচু তপকার তাপস ও সুফি সাধক মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির উক্তিটি ছিলো এভাবে – Music is the cry of creation longing to dissolve into its Creator — a melody where the soul forgets itself and remembers only the Divine.”
অর্থাৎ, “সংগীত হলো সৃষ্টির সেই আকুতি, যেখানে সৃষ্টি নিজেকে ভুলে গিয়ে কেবল স্রষ্টাকে স্মরণ করে; একটি সুর, যেখানে সত্তা নিজেকে ভেঙে স্রষ্টার মাঝে বিলীন হতে চায়।”
সৃষ্টির অন্তরে জাগ্রত যে আকুতি, যে গভীরতম অনুরণন — তা কখনও ভাষায় ধরা পড়ে না, ধরা পড়ে সুরের মূর্ছনায়। আর সেই সুর যখন ভেসে ওঠে আত্মার গহীন থেকে, তখন তা আর নিছক সংগীত থাকে না; হয়ে ওঠে সৃষ্টির আরতি, পরম স্রষ্টার দরবারে নিবেদিত এক নীরব প্রার্থনা।
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি আরো বলেছেন- We have fallen into the place where everything is music.”
এই বক্তব্যে রুমি বোঝাতে চেয়েছেন, পুরো সৃষ্টিই এক ধরনের সঙ্গীত — যার মাধ্যমে সৃষ্টির অন্তরের আরতি প্রকাশিত হয়। সঙ্গীত ও স্রষ্টার স্মরণের ঐতিহাসিক ভিত্তি- ইতিহাসের পাতায় পাতায় আমরা দেখি, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার সাথে সঙ্গীতের নিবিড় সম্পর্ক। ইসলামি সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে সুফিবাদের বিস্তার পর্যন্ত, সঙ্গীতকে আত্মার পরিশুদ্ধি ও ঈশ্বর-অন্বেষণের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়েও সাহাবায়ে কেরাম কখনও কবিতা, কখনও সঙ্গীতের মাধ্যমে হৃদয়ের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত হাসান ইবনে সাবিত (রা.) নবীর সম্মুখে কাব্য আবৃত্তি করতেন, যা ছিল শব্দের আধ্যাত্মিক উচ্চারণ।

সুফিবাদে এই ধারাটি আরও বিস্তৃত হয়। বেলাল (রা.)-এর আজানের সুর থেকে শুরু করে হযরত জালালুদ্দিন রুমী (রহ.)-এর সেমা গান, কিংবা হযরত কায়েদ ছাহেব হুজুর (রহ:), হযরত শাহ সুফি খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ.), হযরত খাজা নাছের আলী (রহ:) ও বাঙলার পীর-দরবেশদের দেহতত্ত্বমূলক গান—সবই মূলত আত্মার স্রষ্টার দিকে ধাবমান হওয়ার এক শিল্পিত প্রকাশ।
সঙ্গীত ও তাসাউফ: সুরের মাধ্যমে আত্মোপলব্ধি- তাসাউফের ভাষায় মানুষের ভেতরকার “না্ফস”, “কালব”, ও “রূহ” — এই তিনটি স্তরের পরিশুদ্ধির জন্য আল্লাহর জিকির, ফিকির, ধ্যানের পাশাপাশি সুর ও সংগীতও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
They ask you (O Muhammad) concerning the soul (Ruh). Say: The soul is from the command of my Lord, and of knowledge, you have been given only a little.”
সুফিরা বিশ্বাস করেন, যখন সুর শুদ্ধ, অন্তর পরিশ্রুত, আর উদ্দেশ্য শুধু আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়া — তখন সেই সুর হয়ে ওঠে রুহের আহ্বান।
জালালুদ্দিন রুমী (রহ.) বলেন —”সঙ্গীত হলো সেই সেতু, যার ওপর দিয়ে আত্মা এই ক্ষণিক দুনিয়া থেকে উঠে যায় অনন্তের সন্ধানে।”
কোরআনে কারীমে বলা হয়েছে-
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ ۖ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُم مِّنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا
তাসাউফ মতে, প্রকৃত সঙ্গীত বা সুর শুধুমাত্র কান দিয়ে শোনা যায় না; তা হৃদয়ে প্রবেশ করে, আত্মাকে জাগ্রত করে, ঈশ্বর-স্মরণকে তরান্বিত করে। তাই সুফি দরবারে সঙ্গীত কখনও শুধু বিনোদন নয়, বরং তা আত্মসংশোধনের এক আধ্যাত্মিক মাধ্যম।
Indeed, it is not the eyes that grow blind, but it is the hearts within the breasts that grow blind.”
— Surah Al-Hajj (22:46)
বাংলার মরমিয়া ধারার ভেতর এই তাসাউফভিত্তিক সুরের প্রবাহ প্রবলভাবে বর্তমান। ফকির লালন শাহ, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম থেকে শুরু করে অজস্র বাউল, সাধক ও সুফি-সন্তরা সঙ্গীতের মাধ্যমে আত্মার জগত উন্মোচন করেছেন।
লালন শাই বলেন —”সুরে সুরে মনের কথা কয়, সে কথা যে বুঝে, মন সেই জনায়।” এই ‘সুর’ হলো আত্মার কথা, যার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে জানতে শেখে, নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝে ফেলে, এবং অবশেষে নিজের ভেতরেই স্রষ্টার অস্তিত্ব উপলব্ধি করে।
কোরআনে কারীমে কলবের উপলব্ধি নিয়ে মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন-
فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى الْأَبْصَارُ وَلَٰكِن تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ
সৃষ্টির আরতি: আরতি শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো নিবেদন, শ্রদ্ধা, ও আত্মসমর্পণ। হিন্দু ধর্মে যেমন প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি করা হয়, তেমনি তাসাউফের দৃষ্টিতে প্রতিটি আত্মা, প্রতিটি হৃদয়, প্রতিটি শুদ্ধ সুর— নিজস্বভাবে আল্লাহর দরবারে এক নিবেদন।
যখন কোনো সঙ্গীত বা সুর মানুষকে অহংকার, কামনা, লোভ থেকে মুক্ত করে পরম সত্তার সামনে দাঁড় করায় — তখন সেটিই হয়ে ওঠে ‘আরতি’। এজন্য সুফি দরবারে ‘কাওয়ালি’, ‘সেমা’, ‘গজল’— এসব কেবল সংগীত নয়, এগুলো আত্মার আরতি, প্রেমের প্রার্থনা, স্রষ্টার প্রতি প্রেমিক সৃষ্টির নিবেদিত আত্মঘাত।
সঙ্গীত, শরিয়ত ও তাসাউফ: বিভ্রান্তির অবসান এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে — শরিয়ত কি সঙ্গীতকে অনুমোদন দেয়? এ বিষয়ে ইসলামী ফিকহে মতভেদ থাকলেও তাসাউফের মূলনীতি হলো — সঙ্গীত যদি মানুষকে পাপের দিকে নয়, বরং আল্লাহর স্মরণে, আত্মার উন্নয়নে, বিনয় ও চোখের পানিতে উদ্বুদ্ধ করে — তবে তা নিষিদ্ধ নয়, বরং তা এক অনন্য আধ্যাত্মিক চর্চা।
ইমাম গায্জালী (রহ.) তাঁর গ্রন্থ “ইহইয়া উলুমুদ্দিন”-এ উল্লেখ করেছেন —”সঙ্গীতের প্রকৃত উদ্দেশ্য নির্ভর করে শ্রোতার অবস্থার উপর। যদি তা অন্তরকে সৃষ্টিকর্তার দিকে ধাবিত করে, তবে তা প্রশংসার যোগ্য।”
ইবনে কায়্যিম (রহ.) বলেন:
“সব সঙ্গীত হারাম নয়, বরং লক্ষ্য ও প্রভাব অনুসারে তা হালাল বা হারাম হয়।”
হযরত বায়াজীদ বোস্তামী (রহ.) বলেছেন —”সঙ্গীত শুদ্ধ হলে, মনও শুদ্ধ হয়। মন শুদ্ধ হলে, চোখের পানি আসে। আর সে পানি আত্মাকে ধুয়ে দেয়।”
সুরের মূর্ছনা: আত্মার মুক্তি বা বিভ্রান্তি? তবে তাসাউফ আমাদের সতর্কও করে। যে সুর কামনা-বাসনা, ভোগ-লালসাকে উস্কে দেয় — তা আত্মার মুক্তি নয়, বরং বিভ্রান্তি। আবার যে সুর নিঃস্বার্থ, শুদ্ধ, প্রেমময়, হৃদয়স্পর্শী — তা আত্মাকে আল্লাহর দিকে ধাবিত করে। তাই সুফিরা বলেন —
“সঙ্গীত বা সুর দুই ধরনের — এক ধ্বংসের পথে, অন্যটি মুক্তির দিকে। নির্বাচন আমাদের নিজস্ব আত্মার প্রস্তুতির উপর নির্ভর করে।”
তাসাউফের মূল দর্শন হলো আত্মা থেকে ‘না্ফস’-এর দাসত্ব সরিয়ে ‘রূহ’-এর স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা। এ পথ জিকির, ফিকির, মোর্শেদের নসীহত, এবং কখনও সঙ্গীতের মাধ্যমে সুগম হয়।
অন্তরের যে আরতি, যে নীরব আকুতি — তা কখনও শব্দে ধরা পড়ে না, ধরা পড়ে নিঃশব্দ সুরের বেদনাভরা মূর্ছনায়। যখন সেই সুর হয় শুদ্ধ, মন হয় সরল, আত্মা হয় নির্মল — তখন প্রতিটি সুর, প্রতিটি ধ্বনি হয়ে ওঠে সৃষ্টির পক্ষ থেকে স্রষ্টার প্রতি নিবেদন। তাসাউফ আমাদের শিক্ষা দেয়, সুরের মাধ্যমে আত্মাকে শুদ্ধ করো, সৃষ্টির ভেতর স্রষ্টাকে খুঁজে নাও, আর প্রতি মুহূর্তে হৃদয়ের গভীরতম বেদনা আর প্রেমের সুরে আল্লাহর দরবারে নিজের আত্মা অর্পণ করো। “সুর নয় শুধুই বিনোদনের, সুর নয় শুধু শব্দের খেলা, সুর — আত্মার আরতি, প্রেমের মিনতি, সুর — স্রষ্টার দরবারে সৃষ্টি-প্রণতি।”
তাসাউফে বিশ্বাস করা হয়, মানুষের অন্তরে আল্লাহর একটি ‘ইশারা’ সদা বিদ্যমান। সুর সেই ইশারাকে উন্মোচনের সহায়ক। কোরআনের আয়াত —
“وَنَفَخْتُ فِيهِ مِن رُّوحِي”
অর্থ: “আমি (মানুষের মধ্যে) আমার আত্মার অংশ ফুঁকে দিয়েছি।”
(সূরা সা’দ: ৭২)
এই আয়াতের আলোকে সুফিরা মনে করেন, স্রষ্টার সেই আত্মিক নিঃশ্বাসকে অনুভব করার অন্যতম মাধ্যম হতে পারে সুর, যদি তা আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে হয়।
তাসাউফের গভীরতায় ডুবলে বুঝা যায় — সুর শুধু কান দিয়ে শোনা যায় না, তা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। সেই উপলব্ধির গভীরে সৃষ্টির আরতি মিশে থাকে, আর স্রষ্টার প্রতি প্রেমের অনন্ত ধারা বইতে থাকে।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা
Daily Bangladesh Bani বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দৈনিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের প্রচার করি।