খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী।।
এক সময় ছিল, যদিও খুব অল্প সময়ের জন্য, যখন আমি জীবন নিয়ে কিছুটা দৃঢ় ছিলাম। আজ স্মৃতির গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি ফিরে যাই এক শিশুকালের দিন, যেদিনের যন্ত্রণা আজও আমার অন্তরে কাঁপন তোলে। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র বারো। আমি তখন মাঠে কাজ করছিলাম—শুধু ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করা একটি বালক, পরিবারে যাকে সবাই জানতো গরু চরানো ছেলেটা হিসেবে। সালটা ছিল ১৯৯২।
তবে আমার রক্তে ছিল অন্য ইতিহাস—এক আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার। আমার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ইসলাম প্রচারের পুণ্যব্রত গ্রহণকারী সুফি সাধক, যারা অবিশ্বাসীদের ভেতর আলোর দাওয়াত ছড়াতে গিয়ে অগণিত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন। তাঁদের সেই আত্মত্যাগ আমাকে আজও অনুপ্রেরণা দেয়।
তাঁদের একজন ছিলেন আমার বড় বাবা শাহ সুফি খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহঃ)—অবিভক্ত বাংলার একজন খ্যাতিমান সুফি সাধক ও ইসলাম প্রচারক। ১৮৪৫ সালে তিনি উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকটি মসজিদ,মাদ্রাসা ও খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি মসজিদ এখনো টিকে আছে বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার অন্তর্গত আরপাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের বালিয়াতলী গ্রামে।
বঙ্গোপসাগরের পাড়ঘেঁষা আমতলীতে তাঁর নিজস্ব বাড়ি ছিল, আর সেখানেই তিনি গড়ে তোলেন একটি মসজিদ,খানকা ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসা। যেখানে স্থানীয় মানুষদের নামাজে আগ্রহ সৃষ্টির চেষ্টা করেন,দ্বীন ও ধর্মের প্রতি, সুন্নত ও তরিকতের প্রতি গোমরাহ মানুষদেরকে আলোর দিকে অগ্রসরের চেষ্টা করেছিলেন । আজও সেই মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে জরাজীর্ণ অবকাঠামোগত অবস্থায় সময়ের সাক্ষী হয়ে। লোকমুখে প্রচলিত নানা অলৌকিক কাহিনী, বিশ্বাস ও ধারণা এই মসজিদকে ঘিরে এখনো বিদ্যমান। এর নাম এখন পরিচিত “সুফি খাজা ফয়জুদ্দিন (রহঃ) জামে মসজিদ কমপ্লেক্স” নামে। আমার শৈশবের বহু সময় কেটেছে আমার দাদা, মৌলভী খাজা নাছের আলী (রহঃ)-এর সান্নিধ্যে ও আদরে, যিনি ছিলেন শাহ সুফি হযরত খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহঃ)-এর প্রিয়তম আধ্যাত্মিক সন্তান। দাদার স্নেহ ও শিক্ষা আমাকে গড়ে তুলেছে ইতিহাস ও বিশ্বাসের মাঝে।
আমার জন্মঘটনার এক আধ্যাত্মিক পটভূমি রয়েছে। সালটা ১৯৭৮। আমার দাদাবাড়ি, সুফি খাজা মৌলভী নাছের আলি (রহঃ)-এর বাড়িতে চলছিল একটি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও সমাবেশ। সেই সময় আমার মা-বাবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার মাঝে পাঙ্গাশিয়া দরবার শরীফের পীর শাহ সুফি হযরত মাওলানা আমিন ছাহেব (রহঃ) আমার দাদাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “এই বিয়ের এক বছরের মধ্যেই একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেবে, যে আপনার ঘরে আলো ছড়াবে। আপনার বংশে জ্যোতি হয়ে বংশের সুনাম সুখ্যাতি ছড়াবে” আজকের আমি—সে ভবিষ্যদ্বাণীরই ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি ।
তখনকার দিনে যেমন হতো, একজন ধাত্রী আমার মায়ের প্রসবে সহায়তা করছিলেন। আশে পাশে উপস্থিত নারীদের মাঝে আমার মায়ের এক চাচাতো বোন হাছিনা বেগম ছিলেন, যিনি তসবিহ হাতে নিয়ে অস্থির পায়ে হেঁটে দোয়া করছিলেন, যেন বাচ্চাটি সুস্থ সবল ছেলে বাচ্চার জন্ম হয়। মধ্যরাতের পর এবং ফজরের আজানের আগ মুহূর্তে আমার প্রথম কান্না শোনা যায়। আল্লাহর রহমতে মা নিরাপদে আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন। আমার বাবা তখন নামাজে মশগুল ছিলেন। হাছিনা বেগম (হাসিনা খালা) তখনই আনন্দে ছুটে যান এবং চারদিকে ছড়িয়ে দেন আমার জন্মের সুসংবাদ—ছেলে হয়েছে। সালটা ছিল ১৯৭৮ ইংরেজি রোজ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত।
কিন্তু সেই জন্মের সাথে ছিল এক বিরাট আত্মত্যাগ। আমার মা, যিনি আমার মুখও তখন ঠিকমতো দেখতে পারেননি, আগেই আল্লাহর কাছে করা একটি মানত পালনের উদ্দেশ্যে আমাকে তুলে দেন আমার দাদা-দাদীর কাছে লালন-পালনের জন্য। কী বেদনার মধ্য দিয়ে মা গিয়েছিলেন তা কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু তিনি ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সে মানত পূরণ করেছিলেন—একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার নারীর মতো। আমার মা হচ্ছেন সম্পূর্ণ ধর্মভীরু ও আধ্যাত্মিক গোচের নারী। আমার ও আমার ছোট বোন ফানা-র জন্মের ব্যবধান মাত্র দুই বছর। ফানার জন্মের পর থেকে আমি দাদা বাড়িতেই বড় হয়েছি বেশিরভাগ সময়। নানা বাড়িতেও অনেক সময় কাটিয়েছি, নানা বাড়ির আশপাশের বাড়িগুলোতেও প্রায়ই যেতাম, সবার ভালোবাসায় বড় হয়েছি। গ্রামবাসী সবার আদরে আমি ছিলাম পরিচিত মুখ। কিন্তু যখন আমি মাত্র তিন/চার বছর বয়সে, তখনই আমার প্রিয় নানা সুফি মৌলভী হামিদ উদ্দিন (রহঃ) ইন্তেকাল করেন।
আমার মা’র একমাত্র ভাই ছিলেন হযরত ক্বারি নূর মোহাম্মদ (রহঃ) (১৯৩৮–১৯৭৪), যিনি ছিলেন উপমহাদেশের বিখ্যাত ক্বারী উজানী পীর হযরত মাওলানা ক্বারি ইব্রাহিম ছাহেব (রহঃ (১৮৬৩–১৯৪৩)-এর স্নেহধন্য ছাত্র ও মুরিদ। ১৯০১ সালে উজানী মাদরাসার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন হযরত ক্বারী ইব্রাহিম ছাহেব (রহঃ) — কুরআন শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম পথিকৃৎ।
আমার মামা, ক্বারী নূর মোহাম্মদ ছাহেব (রহঃ), ছিলেন একজন অপূর্ব কণ্ঠের ক্বারী এ কুরআন। তিনি ছিলেন আমার নানা মৌলভী হামিদ উদ্দিন (রহঃ)-এর একমাত্র পুত্র সন্তান। ১৯৫৯ সালে হযরত মাওলানা সাঈদুর রহমান (রহঃ)-এর নেতৃত্বে আমার পরম শ্রদ্ধেয় নানাসহ আরও কিছু এলাকার পরহেজগার আলেম ও গণ্যমান্যদের উদ্যোগে চাওরা নেছারিয়া ফাজিল সিনিয়র মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার চাওরা গ্রামে, যেখানে আমার নানার বাড়ি।
মাদরাসার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ছারছিনা দরবার শরীফের পীর আল্লামা শাহ সুফি নেছার উদ্দিন (রহঃ)। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ছোট্ট শিশু, আমার মামা—তখন মাত্র ৯/১০ বছর বয়সী—সুমধুর কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করেন। এরপর পীর ছাহেব হুজুর জিজ্ঞেস করেন, “এই ছেলের বাবা এখানে উপস্থিত আছেন? দাঁড়ান তো।” আমার নানা কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়ান—ভয়ভীতিতে ভেবেছিলেন, তাঁর ছেলেটি হয়তো কোনো ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু পীর ছাহেব হেসে বললেন, “আপনার ছেলে আপনার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানের কারণ হবে। সে হবে পবিত্র কুরআনের একজন মহান খাদেম।” এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়। আমার মামা পরিণত হন একজন খাঁটি আলেম ও মহান কুরআনের খাদেমে কুররা হিসেবে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু ঘটে বহু আগেই—আমি জন্ম নেয়ার আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর কণ্ঠ, তাঁর কুরআনপ্রেম, তাঁর ইখলাস আজো মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ স্থানে আসীন করেন। আমিন।
আজ ফিরে তাকালে দেখি—আমার শৈশব ছিল ক্ষুধা, কষ্ট আর সংকটময়। কিন্তু সেই প্রতিকূলতা ছাপিয়ে আমার মধ্যে ছিল এক মহিমান্বিত বংশধারা—সুফি সাধক, আলেম, পীর ও ইসলাম প্রচারকদের রুহানি আত্মা। বালিয়াতলীর মসজিদ থেকে শুরু করে চাওরা নেছারিয়া ফাজিল মাদরাসা পর্যন্ত, নামাজরত পিতা থেকে শুরু করে নামাজি আধ্যাত্মিক খোদাভীরু মাতা পর্যন্ত—সবই যেন আমার আত্মার ইতিহাস।
আমার পূর্বপুরুষেরা আরাম বা ক্ষমতা খোঁজেননি, আমার পূর্বপুরুষেরা সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করেনি, করেছে সমাজ গড়ার কাজ, হানাহানি, দলাদলি ফেরকাবাজির মত সমাজ গর্হিত কাজগুলো থেকে তারা সদা সর্বদা দূরে থেকে সমাজ বিনির্মাণে ও দায়ী ইলাল্লাহর পথে থেকেছে অবিচল। তাঁরা খুঁজেছেন সর্ব অবস্থায় আল্লাহর সন্তুষ্টি।—আমার রক্তে বইছে দাওয়াতের সেই আলোর ধারাবাহিকতা, যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডেকে এনেছে। আমার পা একদিন হয়তো ডোবার কাদায় ছিল, কিন্তু আমার আত্মা—সদা আলোর দিকে ছুটেছে।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা
Daily Bangladesh Bani বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দৈনিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের প্রচার করি।