শুক্রবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৫

বাংলাদেশের বাজেট ইতিহাস ও মানবিকতা

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী।।

গত কদিন ধরে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার ঝড়। সংসদ থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম, টেলিভিশনের টকশো থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, এমনকি চায়ের দোকানের আড্ডাতেও বাজেট এখন এক আলোচিত ইস্যু। অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, তরুণ উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে চাকরি প্রত্যাশী যুবকরাও বাজেট বিশ্লেষণে অংশ নিচ্ছেন। আলোচনার কেন্দ্রে আছে মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ, কর কাঠামো এবং সামাজিক নিরাপত্তা। তবে প্রশ্ন উঠছে এই বাজেট কি যথেষ্ট মানবিক? এতে কি সব মানুষের কণ্ঠ প্রতিফলিত হয়েছে?

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরতে হবে বাজেট ইতিহাসের দিকে যেখানে, একদিকে আছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র, অন্যদিকে আছে মানবিক খাতের দীর্ঘ অবহেলার চিহ্ন।

১৯৭২-৭৩ সাল ৭৮৬ কোটি পুনর্বাসন ও ত্রাণ প্রাধান্য, ১৯৮৯-৯০ সাল ১২,৭০৩ কোটি শিল্পায়ন অগ্রাধিকার, স্বাস্থ্য অবহেলিত, ২০০৯-১০ সাল ১,১৩,৮১৯ কোটি মেগা প্রকল্প, স্বাস্থ্যে জিডিপির ১% এর নিচে, ২০২৪-২৫ সাল ৭,৯৭,০০০ কোটি ঘাটতি ২.২৬ লাখ কোটি, সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ < ৩.০%, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ: মোট বাজেটের মাত্র ৫.৪% (২০২৩-২৪), সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দ: জিডিপির মাত্র ২.৬৫% (WB রিপোর্ট, ২০২4), বেকার তরুণ: ৩৯ লাখ (ILO, ২০২৩), প্রতি ১০০০ শিশুতে মৃত্যু: ২৭ (UNICEF, ২০২৩), জলবায়ু অভিবাসী: বছরে গড়ে ৭–৮ লাখ (IOM)

বাংলাদেশের বাজেট ইতিহাস কেবল অর্থনৈতিক পরিকল্পনার দলিল নয় এটি জাতির স্বপ্ন, সংকট এবং রাষ্ট্রের দর্শনের প্রতিফলন। স্বাধীনতার পর ৫৪ বছর ধরে বাজেটের পরিধি কয়েক কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় আট লাখ কোটি টাকায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বাজেট-অভিযাত্রায় কতটা জায়গা পেয়েছে সাধারণ মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা কিংবা মানবিক কল্যাণ?
আমরা প্রবৃদ্ধি ও পরিকাঠামোতে যতটা এগিয়েছি, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির দিক থেকে ততটাই পিছিয়ে রয়েছি। এই লেখায় বাংলাদেশের বাজেট ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে উঠে আসবে সেই অনুপস্থিত মানবিকতার স্বর।
যুদ্ধ ও পুনর্গঠনের দশক (১৯৭১–১৯৮০): ত্রাণের বাইরে মানবিক উন্নয়ন?
১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের যুদ্ধকালীন বাজেট ছিল মাত্র ৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা। পরবর্তী বাজেটগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল ত্রাণ, পুনর্বাসন ও পরিকাঠামো পুনর্গঠন। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা, যা তুলনামূলকভাবে বড় মনে হলেও এর অধিকাংশই ব্যয় হয়েছিল অবকাঠামো ও প্রশাসনিক কাঠামো পুনঃগঠনে।মানবিক ঘাটতি: এই সময়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা পুষ্টি খাতে স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট সামাজিক প্রতিশ্রুতি প্রায় অনুপস্থিত ছিল। যুদ্ধাহত, বিধবা, এতিম ও বাস্তুচ্যুত মানুষদের জন্য কোনো সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে ওঠেনি।
অবকাঠামো ও শিল্পায়নের অগ্রাধিকার (১৯৮০–১৯৯০): মানুষের চেয়ে অবকাঠামো বড়?

১৯৮০-৮১ সালে বাজেট দাঁড়ায় ৪,১০৮ কোটি টাকা, ১৯৮৯-৯০ সালে এটি পৌঁছে ১২,৭০৩ কোটি টাকায়। এই সময়ের অগ্রাধিকার ছিল বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, শিল্পায়ন এবং বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প। মানবিক ঘাটতি: স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল সামান্য। চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের বদলে “সেলাই মেশিন বিতরণ” ও কিছু মৌখিক স্বাস্থ্য কার্যক্রমই সরকারের মুখ্য পদক্ষেপে পরিণত হয়। এক দশকে মাতৃমৃত্যু হার কমেনি, শিশু মৃত্যুর হারও ছিল ভয়াবহ (প্রতি হাজারে ৯০-এর বেশি)।
রাজস্ব ও ঋণনির্ভর বাজেট (১৯৯০–২০০০): পরিমাণে উন্নতি, দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়, ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে বাজেট দাঁড়ায় ২০,৯৪৮ কোটি টাকা। আয় বাড়াতে রাজস্ব সংগ্রহে জোর দেওয়া হয়, কিন্তু জনগণের জন্য প্রত্যক্ষ সুবিধা নিশ্চিত হয়নি। অভ্যন্তরীণ ঋণ, ব্যাংকিং খাত ও সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা বাড়তে থাকে।

মানবিক ঘাটতি: সমাজসেবা বিভাগের বাজেট ছিল নগণ্য। মেগা প্রকল্প শুরু হলেও শিক্ষিত তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা বা গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছায়নি মানুষের দুয়ারে। নগরের দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলগুলো এবং হিজড়া, দলিত, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো আলাদা বরাদ্দ ছিল না।

২০০৯-১০ অর্থবছরে বাজেট প্রথমবারের মতো ১লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। প্রবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল মূলমন্ত্র।

মানবিক ঘাটতি: একদিকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশ প্রবেশ করে রপ্তানি ও শ্রমবাজারে, অন্যদিকে দেশজ সেবা—বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালের মান, স্কুলের শিক্ষাদান ও প্রান্তিক জনতার জীবনমান—বহুলাংশেই একই রয়ে যায়। স্বাস্থ্য বাজেট জিডিপির ১% এর নিচে থেকে যায় পুরো দশকজুড়ে। সাম্প্রতিক বছর (২০১০–২০২৫): মেগা বাজেট, কিন্তু মানুষের কী লাভ?

২০২৪-২৫ বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৭,৯৭,০০০ কোটি টাকা, ঘাটতি ২,২৬,০০০ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫,৪১,০০০ কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ সালের বাজেটেও ঘাটতির অবস্থান অপরিবর্তিত।

মানবিক ঘাটতি: এত বড় বাজেটে আজও সরকারি হাসপাতালের ৭০% ওষুধ কিনে আনতে হয় রোগীকে। বেকার যুবকের সংখ্যা ৩৯ লাখের বেশি, কিন্তু প্রশিক্ষণ বা কর্মসংস্থানের জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ নামমাত্র। প্রতিবছর জলবায়ু কারণে বাস্তুচ্যুত হয় ৭-৮ লাখ মানুষ, কিন্তু তাদের পুনর্বাসনে নেই ‘মানবিক বাজেট’ বরাদ্দ।

কীভাবে বাজেট হবে সত্যিকারের মানবিক?

জিডিপির অন্তত ৩% স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করুন, বাজেটের ২০% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ, সমাজসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তায় বাজেটের ১৫% রাখুন, যাতে হিজড়া, দলিত, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত হয়, জলবায়ু অভিবাসীদের পুনর্বাসনে বিশেষ বরাদ্দ তৈরি করুন,কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গ্রাম ও শহরভিত্তিক ‘জব ব্যাংক’ প্রকল্প চালু করুন

বাংলাদেশের বাজেট ইতিহাস আমাদের শেখায়—সংখ্যা বাড়লে উন্নয়ন হয় না, যদি মানুষের অধিকার, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সম্মান নিশ্চিত না হয়। বাজেটের আকার বড় হয়েছে, কিন্তু মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনও অপরিণত। উন্নয়ন তখনই সার্থক হবে, যখন মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি ‘মানুষ’ হবে বাজেটের কেন্দ্রে। এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন একটি মানবিক বাজেট, যা প্রবৃদ্ধি নয়, মানুষকে অগ্রাধিকার দেয়।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা

আরো পড়ুন

পাংশায় খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় দোয়া মাহফিল

সাকী মাহবুব রাজবাড়ী প্রতিনিধি।। রাজবাড়ীর পাংশায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *