শুক্রবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৫

বাবুগঞ্জে স্মৃতি আকরে ধরে বেঁচে আছেন জুলাইয়ের ৩বীর শহীদের পরিবার

আব্দুল্লাহ আল মামুন বাবুগঞ্জ প্রতিনিধি।।

জুলাই-আগস্টের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায় দুইজন ছাত্র এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয় কর্মী শহীদ হয়েছেন। ঘটনার এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও ওই ৩শহীদ পরিবারের কান্না আজও থামেনি।

২০২৪ সালের জুলাই মাসের শুরু থেকে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন ওমর গণি (এমইএস) কলেজের বিবিএ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ শান্ত।

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার ব্যবসায়ী জাকির হোসেনের ছেলে শান্তকে হারিয়ে এখনো দিশেহারা তার পরিবার। স্কুল শিক্ষিকা মা কোহিনূর বেগমের কান্না এখনো থামছে না। স্কুলপড়ুয়া ছোট বোনও খুঁজে ফিরে তার ভাইকে। মায়ের চাকরির সুবাদে সপরিবারে চট্টগ্রামের লালখান বাজারে তাদের বাসা ছিল । জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূতিতে শান্তর পরিবারকে শান্ত্বনা দিতে পারছে না কেউ।

ফয়সাল আহমেদ শান্ত নামটি এখন পরিবারের কাছে স্মৃতি। সন্তান নিহতের ১বছর পরও মা কহিনুর আক্তার কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাচ্ছেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক বাবা জাকির হোসেনও। ভাইয়ের অকাল প্রাণহানি মানতে পারছে না ছোটবোন সুমাইয়া জান্নাত বৃষ্টি। গত বছরের ১৬জুলাই গণআন্দোলনে চট্টগ্রাম থেকে লাশ হয়ে বরিশালের গ্রামের বাড়িতে ফিরেছিলেন ফয়সাল আহম্মেদ শান্ত।

১৬জুলাই ২০২৪ চট্টগ্রামের মুরাদপুর ২নং গেটের মাঝামাঝি জায়গায় কোটা সংস্কারে আন্দোলনরত অবস্থায় গুলীতে নিহত হন ফয়সাল আহমেদ শান্ত। গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের মহিষাদী গ্রামে। শান্তর বাবা জাকির হোসেন জাহাজের পুরনো আসবাপত্রের ব্যবসা করেন। সে সুবাদে বাবুগঞ্জে থাকেন তিনি। ছোটবোন বৃষ্টি ও মা কহিনুরকে নিয়ে চট্টগ্রামের ইপিজেডে ভাড়া বাসায় থাকতেন শান্ত। দুই ভাইবোনের মধ্যে শান্ত বড়। ২০২৪ এর ১৭জুলাই অ্যাম্বুলেন্সযোগে নানা বাড়িতে লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। বাবুগঞ্জের মহিষাদী গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে। তাঁর শরীরে তিনটি গুলী লেগেছিল।

শহীদ ফয়সাল আহমেদ শান্তর বাবা জাকির হোসেন বলেন,বিনাদোষে আমার সন্তানকে যারা হত্যা করেছে, তাদের বিচার চাই আমি। আমি জাকির হোসেন শহীদ ফয়সালের গর্বিত পিতা এটাই আমার পরিচয়।

শান্তর মা বলেন, ‘আমার তো অনেক আশা ছিল। আমার ছেলে পড়ালেখা করে অ্যাওয়ার্ড নিয়ে আসবে। আমার বাবা যে এত বড় অ্যাওয়ার্ড নিয়ে আসবে, আমি তো বুঝতে পারি নাই। আমারে সে সেরা মায়ের সম্মান দিয়ে গেল।’ আমি শহীদের সম্মানিত মা, এখন এই পরিচয় আমার জন্য অনেক গর্বের।

নর্থ সউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাপোর্ট স্টাফ ছিলেন আবদুল্লাহ আল আবির (২৭) কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেমে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন। ১৯জুলাই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দিনভর সংঘর্ষ চলে। সন্ধ্যায় গুলিতে পেটের ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাঁর। কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ঢাকা মেডিকেলে অস্ত্রোপচারে ১১ব্যাগ রক্ত দিয়েও বাঁচানো যায়নি তাঁকে। পরদিন ২০জুলাই সকালে হাসপাতালে মারা যান আবদুল্লাহ। ২১জুলাই রাতে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর ক্ষুদ্রকাঠী গ্রামে জানাজা শেষে তাঁকে দাফন করা হয়।

বাবুগঞ্জের ক্ষুদ্রকাঠী গ্রামের মিজানুর রহমান বাচ্চুর ছেলে আবদুল্লাহ বোনের সঙ্গে ঢাকার ভাড়া বাসায় থাকতেন। ভগ্নিপতি মহিমুল ইসলাম নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার সুবাদে আবদুল্লাহরও সেখানে চাকরির ব্যবস্থা হয়। তাঁর পিতা বাচ্চু বরিশাল নগরের জননিরাপত্তা অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। ক্ষুদ্রকাঠী গ্রামে এখনো শোকের ছায়া। একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যু কিছুতেই মানতে পারছেন না বোন মারিয়া আক্তার।

মারিয়া বলেন, গুলিতে তার কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চিকিৎসকেরা একটি কিডনি কেটে ফেলেন। তারপরও ভেতরের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। ১১ব্যাগ রক্ত দিলেও শরীরে ধরে রাখা যায়নি।
ছেলেকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন আবদুল্লাহর মা পারভীন সুলতানা। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে শহীদ হয়েছে। তার বিজয় হয়েছে। কিন্তু আমার আবির দেখে যেতে পারল না।

আন্দোলনে নিহত অপর একজন ছাত্র রাকিব হোসাইন (২৮) বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মানিককাঠি গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেনের ছেলে। ২০২৪ এর ৫আগস্ট আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের কয়েক ঘণ্টা আগে সে নিহত হয়।
রাকিব বরিশাল থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিপ্লোমা করে বিএসসির জন্য ভর্তি হন ঢাকার সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিতে। জানা যায়, শুরু থেকে রাকিব বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।

রাকিবের বড় ভাই আবুল কালাম বলেন, ‘আমার ভাইকে দুইটা গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ। দুইটা গুলিই তার পেটে বিদ্ধ হয়। তবে তলপেটের গুলিটি শরীর ভেদ করে বেরিয়ে যায়।

নিহত রাকিব হোসাইন এর প্রতিবেশীরা জানান, একজন প্রতিবাদী যুবক হিসেবে এলাকায় সুপরিচিত ছিলেন রাকিব। অন্যায় দেখলে মুখ বুজে থাকতেন না তিনি। দুই ভাই, তিন বোনসহ সাতজনের সংসার তাদের। তাঁর কৃষক বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। রাকিবকে ঘিরেই সব স্বপ্ন ছিল তাদের। তাই রাকিবের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ পুনর্বাসন করা প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারুক আহমেদ বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে বাবুগঞ্জ উপজেলায় তিনজন যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন। ইতোমধ্যে আমরা নিহতদের পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি সহায়তা পৌঁছে দিয়েছি। এ ছাড়াও তাদের পরিবারকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদানের জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি। তাদের যেকোনো প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসন পাশে রয়েছে।

আরো পড়ুন

ঝালকাঠিতে খবরেরকাগজ ‘বন্ধুজন’ জেলা কমিটি গঠন

জাহাঙ্গীর আলম।। দৈনিক খবরের কাগজ–এর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বন্ধুজন’–এর ঝালকাঠি জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। মঙ্গলবার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *