শুক্রবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৫

দুর্বল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও একীভূত হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

ব্যাংক খাত সংস্কারে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক খাতের সংস্কার কার্যক্রমের রূপরেখা তৈরি আছে। রূপরেখা অনুযায়ী কাজ শুরু করেছি। সংস্কারের জন্য ছয়টি আইন নিয়ে আসছি। ইতোমধ্যে ব্যাংক রেজুলেশন অ্যাক্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধন করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় সংস্কার করা হবে। এটির মাধ্যমে সরকারের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন চাওয়া হবে। এটি খুবই প্রয়োজন, যাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এছাড়া ব্যাংক কোম্পানি অ্যাক্টও পরিবর্তন করা হচ্ছে। এই আইনে অনেকগুলো ধারা আগের সরকার ব্যাংকিং গোষ্ঠীর চাপে করেছে। এর মধ্যে ১২বছর টানা পরিচালক থাকা, যেটা এখন ছয় বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিবারতন্ত্র অনেক কমিয়ে দিচ্ছি। স্বতন্ত্র পরিচালক ৫০শতাংশ করারও প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

মানি লন্ডারিং কোর্ট আইনেরও পরিবর্তন আনা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশের আর্থিক খাতের বিচারব্যবস্থা খুবই দুর্বল। হাইকোর্টের রিটের কারণে ব্যাংকগুলোর অনেক টাকা আটকে আছে। এভাবে স্থগিতাদেশ দেওয়া আর্থিক খাতের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে স্থগিতাদেশ দেওয়া খুবই ক্ষতিকর, যেটা বিচার বিভাগকে বুঝতে হবে। পৃথিবীর কোথাও ঢালাওভাবে রিট গ্রহণ করে না।

পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে দেশের ভেতরে ও বাইরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি উল্লেখ করে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, চারটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে ইতোমধ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নিতে আইনগত কিছু পরিবর্তন এনেছি, যাতে টাস্কফোর্সকে ক্ষমতা দেওয়া যায়। ১১টি গ্রুপের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আরো অনেকের বিরুদ্ধে হবে। পর্যাপ্ত তথ্য নিয়ে মামলা করতে হবে। শুধু শুধু মামলা করে লাভ নেই।

বাংলাদেশের ঋণ মানের যে পদ্ধতি ছিল, তা পৃথিবীর কোথাও নেই বলে জানান গভর্নর। তাই এটাকে আন্তর্জাতিক মানে রূপ দেওয়ার কথা বলেন তিনি। তিনি জানান, এত দিন এখানে ছয় মাস ও ৯মাস পদ্ধতি ছিল। এখন তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মিলিয়ে তিন মাস করা হয়েছে। ঋণ শোধ করাও একটা মানসিকতার বিষয়। ঋণ না দেওয়ার অভ্যাস হয়ে থাকলে সেটা ছয় মাস ও ৯মাস করেও লাভ নেই। কারণ অনেকে ১৫বছর আগে ঋণ নিয়ে এখনো পুনঃতফসিল সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে। তাই এই অভ্যাস থেকে বের করতেই ঋণমান শ্রেণিকরণে পরিবর্তন আনা হয়েছে।

গভর্নর বলেন, আমরা ১৪টি ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দিয়েছি। এসব ব্যাংক পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। কোনো ধরনের ব্যত্যয় হলে সেখানে আমরা হস্তক্ষেপ করব। আর কোনো ব্যাংকের এমডিকে অন্যায়ভাবে সরানো হলে বোর্ড ভেঙে দেওয়া হবে।

বিগত সরকারের আমলে কিছু ব্যাংক রাজনৈতিকভাবে দেওয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এসব ব্যাংক তাদের পরিবার ও পরিচিত মুখদের দেওয়া হয়। এই ব্যক্তিদের ব্যাংক পাওয়ার যোগ্যতা এবং প্রয়োজনীয়তাও ছিল না। এখন এসব ব্যাংক নিয়ে চলতে হচ্ছে। তাদের আমরা বন্ধ করিনি। তবে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন ফেরাতে চেষ্টা করছি। এসব ব্যাংকের বোর্ড কোনো অনিয়ম করলে সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবে। এর জন্য আলাদা একটি ব্যাংক রেজুলেশন ডিপার্টমেন্ট করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হলো আমানতকারীদের স্বার্থ দেখা।

কোনো করপোরেট উদ্যোক্তার ফ্যাক্টরি এ সরকার বন্ধ করেনি জানিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজনৈতিক কারণ বা অন্য কোনো কারণে একটি প্রতিষ্ঠানও বন্ধ করিনি। বেক্সিমকোর একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয়েছে, যেটা তারা চালাতে সক্ষম হচ্ছিল না। এক্ষেত্রে সরকার থেকে প্রথম তিন মাসের বেতন দিয়ে চালিয়েছে। পরবর্তী সময়ে তিন মাসের বেতন দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, মালিক না চালালে সরকার এখানে কিছু করতে পারবে না। আমরা কারো এলসি বন্ধ করিনি। যাদের বন্ধ ছিল, তাদের এলসি খোলার জন্যও বলছি।

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি মানেই বিনিয়োগ বৃদ্ধি নয় জানিয়ে গভর্নর বলেন, এর আগে বেনামি ঋণ নিয়ে অনেকে পাচার করেছে। তখন ঋণ প্রবৃদ্ধি বেশি হলেও দেশের লাভ হয়নি, বরং ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঋণ নিচ্ছে না। আগে ছিল ‘যে যত পার ঋণ নাও, শোধ করতে হবে না।’ সেই মানসিকতায় ঋণ নেওয়া হয়েছে, দেওয়াও হয়েছে। এখন এসব হচ্ছে না। আমাদের লক্ষ্য ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফেরানো।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমি সব সময় সংকটময় মুহূর্ত কাটিয়েছি। এখন সরকারে এসেছি। তাই এখানে যে সমস্যা পাচ্ছি, সেটাতে আমাকে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হয়নি। যেহেতু কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, তাই সবগুলো লক্ষ্য অর্জন করে যেতে চাই। এর মধ্যে ডলার রেট স্থিতিশীল, রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার রাখা, ব্যাংক খাত যাতে ঘুরে দাঁড়ায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রকে সেবা দিতে পারে। আমি প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, আপনার আমার জন্য এটা শেষ সুযোগ দেশের জন্য কিছু করে যাওয়ার। আমরা অনেক জায়গায় অনেক কিছু করেছি। তবে এখন সরকারের ভেতর থেকে কিছু করার সুযোগ এসেছে। বাইরে থেকে অনেক কিছু বলার সুযোগ থাকে, করার সুযোগ থাকে না—যেটা সরকারের ভেতর থেকে করা যায়। আমাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আর মাথা উঁচু করে যাতে সম্মানের সঙ্গে বের হয়ে যেতে পারি।

রিজার্ভ চুরির মামলা নিয়ে তিনি বলেন, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে হিয়ারিং হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে আমরা যদি প্রমাণ করতে পারি, তাহলে আমাদের পক্ষে রায় আসতেও পারে। এছাড়া দেশের মধ্যে তদন্ত চলছে। সেটা সরকারের তদন্তকারী সংস্থাগুলো দেখছে। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কেউ যদি জড়িত থাকে, তাহলে সেই অনুযায়ী কমিটি ব্যবস্থা নেবে। আর বর্তমানে সেইফগার্ডে কোনো সমস্যা আছে কি না, তাও দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে কোনো ব্যক্তিগত লকার থাকবে না জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা এটা বন্ধ করে দিচ্ছি। তবে আইনগত জটিলতার কারণে এখন করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ কিছু লকার ফ্রিজ করা হয়েছে। এখন চাইলে এসব লকারের জিনিসপত্র কাউকে নিয়ে যেতে বলতে পারছি না। যখন ফ্রিজ উঠে যাবে, তখনই এটা বন্ধ করে দেওয়া হবে—নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। আমাদের কথা হলো, লকার থাকবে বেসরকারি ব্যাংকে। যেটা পৃথিবীর অনেক দেশে রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কোনো লকার থাকবে না।

আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ব্যাংকের সুদহার কমানোর ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, দেশে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে কিছুটা সফল হয়েছে বর্তমান সরকার। আশা করা হচ্ছে, শিগগিরই মূল্যস্ফীতি আরো কয়েক শতাংশ কমবে। এই হার ৩ শতাংশের ঘরে নামার সম্ভাবনাও দেখছেন তিনি। এই আশাবাদ থেকে ব্যাংকের সুদহার কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তিনি জানান, মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের মধ্যে নামলেই সুদহার কমবে।

ডলার রিজার্ভ ঠিক রেখে টাকার মান কীভাবে ধরে রাখলেন জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশে চরম ডলার সংকট ছিল—এখন আর সেটি নেই। দায়িত্ব নেওয়ার সময়ও সংকটের মধ্যে আমরা সার, বিদ্যুৎ, জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো মোকাবিলা করেছি। যাদের কাছে বেশি ডলার ছিল, আমরা তাদের থেকে নিয়ে অন্যদের দিয়ে সরবরাহ চাহিদা পূরণ করেছি। আবার ডলার মার্কেটও স্থিতিশীল রাখা হয়েছে। ডলারের রেট প্রথমে ব্যাংকগুলোকে ১২২ টাকায় রাখতে বলেছি। পরবর্তী সময়ে বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছি।

অনেকে ভেবেছিলেন বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে ডলারের দর ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা হয়ে যাবে। তবে আমাদের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বাজারে ডলারের রেট নির্ধারণ হচ্ছে। ডলার বাজার স্থিতিশীল থাকাটাও মূল্যস্ফীতি কমাতে ভূমিকা রেখেছে।

আরো পড়ুন

‎গৌরনদীতে অজ্ঞাত পরিবহনের ধাক্কায় নিহত-১

সোলায়মান তুহিন গৌরনদী প্রতিনিধি।। ‎বরিশাল–ঢাকা মহাসড়কের গৌরনদী উপজেলার সাউদের খালপার এলাকায় দ্রুতগামী অজ্ঞাত পরিবহনের ধাক্কায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *