আহমেদ বেলাল।।
বাংলা কবিতার দীর্ঘ পরিক্রমায় কিছু কিছু নাম প্রজন্মের মননে গেঁথে যায় নিঃশব্দে, স্বকীয়তা ও সৃজনশীলতার বলে। এমনই একজন কবি বরিশালের সন্তান, কবি কামাল আহসান—যিনি অপ্রচলিত আলোয়, নিঃশব্দে এবং আন্তরিকতায় নির্মাণ করে গিয়েছেন বাংলা কবিতার এক নতুন অধ্যায়।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা:
নব্বই দশকে বাংলা সাহিত্যে যে ক’জন কবির আবির্ভাব ঘটেছে তাদের মধ্যে কবি কামাল আহসান অন্যতম। কামাল আহসানের জন্ম পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার উত্তর কেশবপুর গ্রামের স্বনামধন্য এক মুসলিম পরিবারে ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩ সালে। শৈশব থেকেই প্রকৃতি ও লোকজ জীবনের ছোঁয়ায় গড়ে ওঠে তাঁর কাব্যচেতনা,যদিও পারিবারিকভাবে সাহিত্য-সংস্কৃতির তেমন কোনো ছোঁয়া পাননি তিনি। হাতেগোনা কয়েকজন বড়ভাই ও বন্ধুদের হাত ধরেই সাহিত্য অঙ্গনে তাঁর প্রবেশ। এরপর-আমৃত্যু তিনি সাহিত্য সাধনা করে গেছেন একান্ত নিজের মত করেই। শহরের কোলাহল আর গ্রামীণ নীরবতার দ্বন্দ্ব তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে ঘনঘন, যেমন তিনি লিখেছেন—
“নির্জন নদীর মতোই আমি—
ডাকে শহর, ঘুম পাড়ায় মেঘ।”
কিংবা_
“রোদের গতির মতন পশ্চিমে যেতে যেতে
ফেলে যাও সবকিছু আলগোছে;
হেঁটে যাও সরল শর্তের মতো একা-
মোহনায় মুখ রেখে নদীদের পাশ ঘেঁষে ঘেঁষে।”
সূত্র: বিমুগ্ধ সন্ধ্যার গান(কাব্যগ্রন্থ)
শিক্ষা ও কর্মজীবন:
শিক্ষা জীবনে কামাল আহসান ১৯৮৯ সালে কেশবপুর এন এস মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এস এস সি পাশ করেন। এরপর তিনে চলে আসেন বরিশালে। বরিশালের স্বনামধন্য ‘অমৃত লাল দে’ কলেজ থেকে ১৯৯২ সালে এইচ এস সি পাশ করেন। এরপর বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে এম এস এস পাশ করার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর শিক্ষা জীবন শেষ করেন। কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেছেন। এছাড়াও তিনি শেকড় সাহিত্য পত্রিকা ও বেশ কয়েকটি অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন।
সাহিত্যচর্চা ও কাব্যরীতি:
কামাল আহসানের লেখালেখির শুরু আশির দশকের শেষদিকে। শুরু থেকেই তিনি প্রচলিত ছন্দ, উপমা, রূপক থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন। তাঁর কবিতায় আমরা দেখি মুক্তছন্দের অবলম্বন, চিত্রকল্পের নতুন ভাষা এবং আবেগের সংক্ষিপ্ত অথচ গাঢ় প্রকাশ। ১৯৯৬ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘প্রণয়দষ্টিতা’ প্রকাশিত হয়। এরপরে ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আহসান জেনে গেছে বরফের ছল’। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৮ সালে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষ মানুষ বলে সুনাম ছড়াবো’ প্রকাশিত হয়। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২১ শে কবির জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ ‘বিমুগ্ধ সন্ধ্যার গান’ প্রকাশিত হয়। কবির সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ হলো- ‘রঙের রাধিকা’,যা ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়।
কবিতা ও কাব্যগ্রন্থ:
তাঁর লেখা জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থগুলো হলো-
১. আহসান জেনে গেছে বরফের ছল (২০০০)
২. মানুষ মানুষ বলে সুনাম ছাড়াবো (২০১৮)
৩. বিমুগ্ধ সন্ধ্যার গান (২০২১)
৪. রঙের রাধিকা (২০২৪)
গল্পগ্রন্থ:
১. প্রণয়দষ্টিতা (১৯৯৬)
এই বইগুলোতে আমরা দেখি, সমাজ, প্রেম, একাকিত্ব, স্মৃতি ও মৃত্যুর গভীর অনুসন্ধান। এছাড়া সত্য, সুন্দর, একেশ্বরবাদ, পরকাল, নবী-রাসুল, দেশপ্রেম ও প্রেম-ভালবাসার মত ইতিবাচক বিষয়ই ছিল তাঁর লেখার মূল অনুষঙ্গ।
কবিতার ভাষা ও দর্শন:
কামাল আহসানের কবিতা সহজবোধ্য হলেও তা গভীরভাবে দার্শনিক ও বিমূর্ত। তাঁর কবিতা যেন পাঠককে শুধুই অনুভব করায় না, বরং ভাবায়। তিনি শব্দ দিয়ে শুধু ছবি আঁকেন না, আঁধারের মধ্যেও পাঠককে আলো খুঁজে পেতে সাহায্য করেন।
যেমন তিনি লিখেছেন_
“সাদাসিধা চাষি নিয়ে কেন করো তামাশা এমন!
রেখে যাবে পৃথিবীর পথ জুড়ে চাষযোগ্য মন।”
অথবা_
“তারপর গতি পায় ছায়া- পথহারা পথিকের পায়
পরাজিত আলো জ্বলে একা;ঘোর লাগা ঘরের মায়ায়।”
সূত্র: বিমুগ্ধ সন্ধ্যার গান (কাব্যগ্রন্থ)
তাঁর কবিতায় সময়, স্মৃতি এবং আত্মজিজ্ঞাসার বিষয়গুলো এমনভাবে উঠে এসেছে, যা পাঠকের ভেতরের স্তরগুলো নাড়া দেয়। যেমন তিনি লিখেছেন_
“এসো স্বপ্ন,এসো ব্যারাকের বাইরেই এসো!
সমস্তরকম জোছনাকে ভেঙেচুরে এসো…
এক বালিশে দু’জন একত্রে ঘুমাবো আজ।”
সূত্র: মানুষ মানুষ বলে সুনাম ছড়াবো(কাব্যগ্রন্থ)
তিনি লিখেছেন, মৃত্যু এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে। মৃত্যু নিয়ে তাঁর যে জীবন দর্শন তা ফুটে উঠেছে তাঁর এই লেখায়_
“তোমাদের কোমল চাহনির অনুবাদ গুঁজে রেখে
হেসে উঠবো একাকী মৃত্যুকে ডানকোলে তুলে।”
জীবন এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে কবির দর্শন ফুটে উঠেছে এভাবে_
“ভেতরে আমার খেলা করে রোজ হাবিয়ার ভয়,
নামুক সন্ধ্যারা তবু দেখে আসি;
রাতভর বাগানে বাগানে কিসের জিকির হয়।”
সূত্র: মানুষ মানুষ বলে সুনাম ছড়াবো (কাব্যগ্রন্থ)
প্রভাব ও উত্তরাধিকার:
কবি কামাল আহসান হয়তো জাতীয় পর্যায়ে অতটা আলোচিত নন, তবে বরিশাল ও দক্ষিণ বাংলার তরুণ লেখকদের মাঝে তিনি এক নীরব অনুপ্রেরণার বাতিঘর হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছেন। তাঁর নির্লিপ্ত কিন্তু গভীর সাহিত্যচর্চা প্রমাণ করে, খ্যাতির চেয়ে গভীরতা অনেক বেশি মূল্যবান।
কবি কামাল আহসান আমাদেরকে শেখান—কবিতা কেবল শব্দের বিন্যাস নয়, এটি আত্মার প্রকাশ। বরিশালের এই সৃষ্টিশীল সন্তান বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন এক নিঃশব্দ, অথচ অনন্য কণ্ঠস্বর। তাঁর কবিতা আমাদের বর্তমানকে স্পর্শ করে, আর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে।
মৃত্যু:
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, কবি কামাল আহসান চট্টগ্রামে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বেই ‘মৃত্যু’ নিয়ে তিনি তাঁর দর্শন তুলে ধরেন ‘মৃত্যুকে ডানকোলে রেখে’ নামক একটি কবিতায়, এভাবে_
“কোলে আমার ঘুমিয়ে থাকে তাজা মৃত্যুর সংবাদ,
হেসে উঠি সকরুণ শব্দে;
গোপনে ডেকেছি তারে,আহা প্রিয় স্বপ্নের শেষ সাধ।”
সূত্র: মানুষ মানুষ বলে সুনাম ছড়াবো (কাব্যগ্রন্থ)
তাঁর লেখা অসংখ্য কবিতা অপ্রকাশিত রয়ে গেছে, যেগুলো ধীরে ধীরে বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এবং হবে।
“কবিতা যদি নিঃশব্দ ক্রন্দন হয়, তবে কবি কামাল আহসান থাকবেন সেই ক্রন্দনের নিঃশব্দ সঙ্গী হয়ে।”
Daily Bangladesh Bani বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দৈনিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের প্রচার করি।