আহমেদ বেলাল।।
বরিশাল হলো শিল্প- সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত এক জনপদ। এ অঞ্চলের নদী, খাল, বিল ও প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য যুগে যুগে কবিদের খুব গভীরভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে বরিশালে জন্মগ্রহণ করে বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে যে ক’জন কবি আধুনিক বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র সত্তা গড়ে তুলেছেন, তাঁদের মধ্যে কবি আল হাফিজ অন্যতম।
তিনি সমকালীন কাব্যভাষার এক শক্তিমান কণ্ঠস্বর, যিনি তাঁর কাব্যে মানবজীবন, প্রেম, প্রকৃতি ও সমাজবাস্তবতাকে অনন্যভাবে প্রকাশ করেছেন।
তিনি শুধু কবি নন, বরং মানবিক চেতনা ও সমাজসচেতনতার কণ্ঠস্বর। তাঁর কবিতা আমাদের মুগ্ধ করে, ভাবায় এবং একইসাথে সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে।
জন্ম ও শৈশবঃ কবি আল হাফিজের জন্ম বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ (বিমানবন্দর) থানাধীন চাঁদপাশা (মধ্য কিসমত) নামক গ্রামে ৩ জানুয়ারি, ১৯৭১ সালে, এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। বাবা মৌলভী মোহাম্মদ এছাহাক আলী হাওলাদার ও মাতা জহুরা খাতুনের স্বপ্ন ছুঁয়ে যার বেড়ে ওঠা। স্ত্রী নাসরিন আক্তার ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা এবং তাদের একমাত্র সন্তান শাহাদাত হাসান রুম্মান। শৈশব থেকেই তিনি প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন। গ্রামীণ জীবনের সহজ-সরল রূপ, নদীমাতৃক বাংলার সৌন্দর্য ও সামাজিক বৈচিত্র্য তাঁর মানসগঠনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা, যে রূপ ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে তাঁর লেখা কবিতায় ও ছন্দে। হয়ে ওঠেন সাহিত্য অঙ্গনের পরিচিত মুখ, হয়ে ওঠেন কবি আল হাফিজ।
শিক্ষাজীবন ও সাহিত্যচর্চাঃ শিক্ষাজীবনে কবি আল হাফিজ ছিলেন অত্যান্ত মেধাবী একজন ছাত্র। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করার পাশাপাশি বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে কামিল -এম এ (মাওলানা) পাস করেন। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাকে আপন করে নেন। বালকবেলা থেকেই তাঁর লেখালেখির হাতেখড়ি।বিভিন্ন দেয়ালিকা, সাময়িকী ও সাহিত্যপত্রে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি নিয়মিত সাহিত্যসভা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন। এই সময়েই তাঁর কবিতায় রূপ নিতে শুরু করে আধুনিক কাব্যচেতনা, দার্শনিকতা এবং মানবিক বোধ। সাহিত্য- সংস্কৃতি সহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর কথাসাহিত্য নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেছেন। জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক পত্রিকা সহ লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন।
সাহিত্যকর্ম ও কাব্যগ্রন্থঃ কবি আল হাফিজের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে নতুন সমৃদ্ধি। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে—
চিচিং ফাঁক : ছড়ার বই (১৯৯৪)
অপরিহার্য ক্রোধ: কাব্যগ্রন্থ (১৯৯৬)
মমতার চাষবাস: কাব্যগ্রন্থ (১৯৯৯৯)
ডাগর ইমেজ: কাব্যগ্রন্থ (২০০৬)
লাল ঘোড়ার ডিম: ছড়ার বই (২০০৬)
পানির প্রলয়: কাব্যগ্রন্থ (২০০৭)
ভার্জিন জোছনার ডেউ: কাব্যগ্রন্থ (২০০৮)
হাহাকার ডটকম: কাব্যগ্রন্থ (২০০৯)
নির্মানাধীন আলোর টাওয়ার: কাব্যগ্রন্থ (২০১৩)
এছাড়াও রয়েছে প্রকাশিতব্য ছড়ার বই “মন উড়ে যায় ঘুড়ির লেজে”।
তারুন্যোত্তর সমসাময়িক বাংলা কবিতার নিগূঢ় আলোচনায় ঈর্ষনীয়ভাবে উচ্চারিত আল হাফিজ। তিনি সেই স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল কবি-যিনি জানেন, প্রগাঢ় কল্পনা ও পাথরবাস্তবতার মিশ্রনে কীভাবে মুখের ভাষার বিস্ময়কর বুননে কবিতাকে জাগ্রত করতে হয় প্রানপ্রতিমায়। কীভাবে সমকালকে করে তুলতে হয় চিরকালীন চিত্রকল্পময় সুদৃঢ় অভিজ্ঞানে। আশ্চর্য নির্মানশৈলীর ছোঁয়ায় তার কবিতার শরীর ও মন হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক শৈল্পিক কারিশমা। বিদ্রুপের ছলে সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরেন গভীর তাৎপর্যের মহিমায়। ‘ঝাঁকের কই’ ও ‘এক নম্বর ভেজাল’ নামক কবিতায় তিনি লিখেছেন-
“সন্দেশের এক গল্প শোনো অল্প কথায় কই
ইদুর-বিড়াল এক পেয়ালায় খাচ্ছে দেশের দই।”
সূত্র: লাল ঘোড়ার ডিম (কাব্যগ্রন্থ, পৃ-৪৭)
অথবা,
“ভেজাল ভেজাল সবই ভেজাল
ভেজাল মরার কাস্টে,
ভেজাল ফাঁসির আসল খবর
বেরোয় গিয়ে লাস্টে।”
সূত্র: লাল ঘোড়ার ডিম (কাব্যগ্রন্থ, পৃ-৪৮)
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অস্তিত্বের টানাপোড়েনের কাব্যিক প্রতিফলন প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কোন কোন লেখায়, যেমন-
“ইতিহাসে খোলামেলা হাঁসগুলো রোজ
শেয়ালের রুচি মতো ভাগ হয়ে যায়
আগাম জমায় আর দানে-অনুদানে
জমে ওঠে মেদভূঁড়ি ছোয়াবের ডোজ।”
সূত্র: হাহাকার ডটকম (কাব্যগ্রন্থ, পৃ-০৯)
কিংবা,
“পেয়ালায় চাঁদ হাসে বেদনার ছাদে
ডাকঘরে ঘর নেই লিপিকলা কাঁদে।”
সূত্র: হাহাকার ডটকম (কাব্যগ্রন্থ, পৃ-৪২)

কবির “বিবস্ত্র সম্ভ্রম” কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে সমাজের অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। কবি লিখেছেন –
“হরিলুটে ভেসে গেছে, খোয়া গেছে ব্যাংকের গোপন লকার।
ভেসে গেছে মানবতা, ফেঁসে গেছে উকিলের কালো এপ্রোন।”
সূত্র: বিবস্ত্র সম্ভ্রম (কাব্যগ্রন্থ, পৃ-১৬)
তাঁর লেখা “নির্মানাধীন আলোর টাওয়ার” কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে প্রেম ও অভিমানের দারুণ মূর্ছনা! শিউলি ফুলের আহবান নামক কবিতায় তিনি লিখেছেন-
“আকাশে রেখেছি হাত, চন্দ্র তারায়
পাতালে খুঁজেছি জল, নম্র ছায়ায়
প্রতিবেশি শিউলির মত কেউ আর-
হৃদয়ে ডাকেনি আজো মিলন মায়ায়।”
সূত্র: নির্মাণাধীন আলোর টাওয়ার (কাব্যগ্রন্থ, পৃ-১১)
মানুষের স্বপ্ন, সংগ্রাম ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কাব্যচিত্র ফুটে উঠেছে তাঁর “হাহাকার ডটকম” কাব্যগ্রন্থের দিন বদলের পঙক্তি মালায়, যেমন-
“প্রতিদিন ভোর আসে মুখ করে লাল
সূর্যকে মনে হয় রঙ করা থাল
স্বপ্নের বীজ ধানে ভরা তার বুক
ভালো হয়ে যায় সব অসুখ-বিসুখ।”
সূত্র: হাহাকার ডটকম (কাব্যগ্রন্থ, পৃ-১৮)
উপরের পংক্তিগুলোই প্রমাণ করে যে, আল হাফিজের কবিতা কেবল আবেগঘন নয়, বরং সমাজমনস্ক ও চিন্তাশীল।
কাব্যচেতনা ও দর্শনঃ দ্রোহ-প্রেম আর অধ্যাত্ম দর্শনের এ এক গোপন মিউজিয়াম। যেখানে গায়ে গা লাগিয়ে লেপটে থাকে স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন, আনন্দ ও বেদনা এবং শাসন ও দুঃশাসনের অচিন্তনীয় চিত্রাবলী-দেশ থেকে দেশান্তরে যার দুঃসাহসিক অভিযাত্রা। নান্দনিকতার ক্ষেত্রে উপমা রূপক চিত্রকল্পের ডাগর সংযোজন-তার কবিতাকে দিয়েছে নতুনতর এক অনন্য মাত্রা।
কবি আল হাফিজের কবিতায় একদিকে যেমন রয়েছে প্রেম-বিরহের কোমল আবেগ, অন্যদিকে রয়েছে বাস্তবতার কঠিন অভিঘাত। তাঁর কবিতায় প্রেম কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, বরং এক সামাজিক দায়বদ্ধতা।
প্রকৃতি তাঁর কবিতায় কখনও রূপক, কখনও জীবনদর্শনের প্রতীক। সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে। অস্তিত্ববোধ ও সময়চেতনা তাঁর কবিতায় গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন—কবিতা কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং সমাজকে জাগ্রত করার এক শক্তিশালী মাধ্যম।
পাঠকের দৃষ্টিতে আল হাফিজঃ সমকালীন সাহিত্য সমালোচকরা কবি আল হাফিজকে আধুনিক কবিতার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে মূল্যায়ন করেন। তাঁর কবিতায় ভাষার নির্মাণশৈলী, চিত্রকল্প ও ছন্দের বৈচিত্র্য পাঠককে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। তাঁকে মানবতার কবি ভুল হবে না। প্রেম ও প্রতিবাদের দার্শনিক কণ্ঠ হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়।
সাহিত্যাঙ্গনে অবদানঃ সাহিত্যচর্চায় কবি আল হাফিজ হলেন একজন দক্ষ সংগঠক। তিনি বরিশালের শেকড় সাহিত্য সংসদের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সাহিত্যসভা, পাঠচক্র ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তরুণ কবি-লেখকদের সৃজনশীলতাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর উদ্যোগে গড়ে উঠেছে এক প্রাণবন্ত সাহিত্যভুবন, যা আজও নবীন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।
পুরস্কার ও স্বীকৃতিঃ তাঁর কাব্যপ্রতিভা ও সাহিত্যসেবার জন্য তিনি একাধিক সাহিত্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। টাঙ্গাইল কবিতা উৎসব পদক- ২০০২, ম্যান অব দ্য ইয়ার- ২০০৪ (আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট), কোটালিপাড়া নাট্যকলা পদক- ২০০৪, লালন শাহ পুরস্কার- ২০০৭ এবং শীলন সাহিত্য পুরস্কার- ২০০৯ ইত্যাদি পুরস্কারসহ আরো বহু পুরস্কার এবং সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে পাওয়া এসব স্বীকৃতি কেবল তাঁর ব্যক্তিগত কৃতিত্ব নয়, বরং তা বাংলাদেশের সাহিত্যভূমির মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে।
কবি আল হাফিজ নিঃসন্দেহে বরিশাল তথা সমগ্র বাংলার গৌরব। তাঁর কবিতায় আমরা খুঁজে পাই প্রেম, প্রকৃতি, মানবতা, সংগ্রাম ও অস্তিত্ববোধের সার্থক প্রতিফলন। তিনি শুধু একজন কবি নন, বরং সমাজসচেতন এক চিন্তক, যিনি বাংলা সাহিত্যে রেখেছেন এক অমর ছাপ। আগামী প্রজন্ম তাঁর কবিতা থেকে অনুপ্রেরণা পাবে, খুঁজে নেবে জীবনের অর্থ, আর বুঝতে শিখবে মানবতার মর্ম।
Daily Bangladesh Bani বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দৈনিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের প্রচার করি।