শুক্রবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৫

নারী নিগ্রহ ও সামাজিক শিক্ষার অভাব

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী।।

২০২৪ সালের Bangladesh Bureau of Statistics (BBS) ও United Nations Population Fund (UNFPA) যৌথ জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ৭৬ শতাংশ নারী তাঁদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার শারীরিক, যৌন, মনস্তাত্ত্বিক বা অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। গত ১২ মাসে এই ধরনের সহিংসতা ভোগ করেছেন প্রায় ৪৯ শতাংশ নারী। সংসারভিত্তিক সহিংসতা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে — মোট নারীর প্রায় ৫৪ শতাংশ কখনও তাঁদের স্বামী বা সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক অথবা যৌন সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন। এসব পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সহিংসতা প্রায়ই গোপনে থাকে: প্রায় ৬২ শতাংশ ভুক্তভোগী কেউ না কাউকে বিষয়টি ব্যক্ত করেননি।

বাংলাদেশের সমাজে নারী নিগ্রহের ভয়াবহতা দিন দিন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন আর সেটি কোনো সংবাদ হয়ে উঠছে না—বরং এক অভ্যস্ত নীরবতা। কয়েকদিন আগেই ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে এক অনার্সপড়ুয়া তরুণী আত্মহত্যা করেছে। সুইসাইড নোটে সে লিখেছিল— “আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী আমার দুর্ভাগ্য।” কিন্তু এই দুর্ভাগ্য কি কেবল ভাগ্যেরই, নাকি সমাজের নির্মম নোংরা বাস্তবতার ফল? মৃত্যুর পরও সে শান্তি পায়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, তার লাশ পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই অমানবিকতা শুধু নারী নিগ্রহ নয়, এটি মানুষত্বের শেষ বিন্দুর পতন।

বাংলাদেশে প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললেই দেখা যায়, নারী নির্যাতনের কোনো না কোনো ভয়াবহ খবর। কেউ ধর্ষণের শিকার, কেউ প্রেমে প্রতারিত হয়ে আত্মহত্যা করেছে, কেউ পারিবারিক সহিংসতায় মারা গেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে প্রায় পাঁচ হাজার নারী বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ বা হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শিশু ও কিশোরীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এতো ভয়াবহ পরিসংখ্যানের পরও সমাজে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং নারীর প্রতি সহিংসতা যেন আরও নির্মম ও বিকৃত আকার ধারণ করছে।

সমস্যার মূল জায়গাটি কেবল আইনি নয়, এটি এক গভীর নৈতিক সংকট। পরিবারের ভেতর থেকেই শুরু হয় অবমাননা—যেখানে কন্যা সন্তানকে বোঝা ভাবা হয়, নারীকে ভোগের বস্তু হিসেবে দেখা হয়, সেখানে পুরুষের চোখে নারী মানে ‘অধিকারহীন ভোগ্য বস্তু’। বিদ্যালয়ে, অফিসে, রাস্তায়—সব জায়গায় এই মনস্তত্ত্ব কাজ করছে। শিক্ষিত তরুণ সমাজের মধ্যেও যে যৌনবিকৃতি ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রকাশ পাচ্ছে। মেয়েদের গোপন ছবি ছড়ানো, ব্ল্যাকমেইল করা, ভিডিও রেকর্ডিং করে মানসিক নির্যাতন—সবই এখন নতুন রূপে নারী নিগ্রহের হাতিয়ার।

যে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল, তার সাথেও ঘটেছিল মানসিক ও সামাজিক নির্যাতনের এক দীর্ঘ অধ্যায়। প্রেমের নামে প্রতারণা, সম্পর্ক ভাঙার পর অপমান, চরিত্রহনন—শেষে সে নিজের জীবনটাই শেষ করে দেয়। কিন্তু মৃত্যুর পরও সমাজ তাকে ছেড়ে দেয়নি। এ যেন এক মৃতদেহের ওপরও লালসার অগ্নি। এই লালসা কেবল এক বিকৃত পুরুষ নয়, এক অসুস্থ সমাজের প্রতিচ্ছবি। সমাজ যখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, মৃতদেহকেও যৌন লালসার শিকার হতে হয়, তখন বোঝা যায় আমরা মানব সভ্যতার কোন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি।

ইসলাম নারীকে যে মর্যাদা দিয়েছে, তা মানব সভ্যতার ইতিহাসে অতুলনীয়। কুরআনে বলা হয়েছে— “ও তোমরা নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো” (সূরা আন-নিসা, ৪:১৯)। নবী করিম (সা.) বলেছেন— “তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করে।” কিন্তু আমাদের সমাজে এই শিক্ষা কেবল মুখস্থ, জীবনে বাস্তবায়ন নেই। যারা দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, তারাও ঘরে স্ত্রীকে মারধর করে, বাইরে মেয়েদের দিকে কু-দৃষ্টি দেয়। ধর্মীয় চেতনা কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থেকে গেলে নৈতিক বিপর্যয় অনিবার্য।

নারী নিগ্রহের আরেকটি দিক হলো বিচারহীনতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, প্রমাণের অভাবে খালাস পেয়ে যায় আসামি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক সদস্যও দুর্বল তদন্ত, সামাজিক প্রভাব কিংবা ঘুষের কারণে অপরাধীকে রক্ষা করে। ভুক্তভোগী পরিবার হয়রানির শিকার হয়, সমাজের কাছে হেয় হয়, শেষে ন্যায়বিচারের আশাই ছেড়ে দেয়। এর ফলে অপরাধীর মনে জন্ম নেয় এক ভয়ংকর আত্মবিশ্বাস—সে জানে, এই দেশে নারীর কান্না কেউ শোনে না।

এই ভয়াবহ চক্র থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো—নৈতিক ও সামাজিক পুনর্জাগরণ। শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতা, মানবতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে বাস্তব পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পরিবারে সন্তানদের শেখাতে হবে নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে খুতবা, ওয়াজ, আলোচনায় নারীর মর্যাদা ও অধিকার বিষয়ে কথা বলতে হবে। রাষ্ট্রকে কেবল আইন প্রণয়ন নয়, বরং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে দ্রুত ও দৃঢ়ভাবে।

একটি বিষয় স্পষ্ট—নারীর প্রতি এই সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি এক গভীর সামাজিক অসুখের লক্ষণ। যখন কোনো জাতি তার নারীকে সম্মান করতে শেখে না, তখন সে জাতি কখনও সভ্য হতে পারে না। আর যখন মৃত নারীর দেহকেও ধর্ষণ করা হয়, তখন সেই সমাজের হৃদয়ও মৃত।

আজ প্রয়োজন সাহসী সামাজিক প্রতিরোধ, যেখানে পুরুষ ও নারী একসাথে বলবে—এই নোংরামি আমাদের নয়। প্রয়োজন এমন এক প্রজন্ম, যারা নারীকে দেহ নয়, আত্মা হিসেবে দেখতে শিখবে। কারণ নারী কোনো ভোগ্য বস্তু নয়—সে এক মা, এক বোন, এক সঙ্গী, এক মানুষ।

যে সমাজ নারীর চোখের পানি দেখতে পায় না, সেই সমাজ শেষ পর্যন্ত নিজের ধ্বংসও দেখতে বাধ্য হয়। তাই এখন সময় এসেছে আমাদের মানবিক বিবেককে পুনর্জাগ্রত করার। অন্যথায়, আগামী দিনের ইতিহাস লিখবে—এক জাতি, যারা লজ্জায় নিজের মুখ দেখাতে পারেনি, কারণ তারা মৃত নারী পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনি।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এবং ব্রাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের কর্ম-অভিজ্ঞ।

আরো পড়ুন

বাবুগঞ্জের ইউএনও’র বদলি স্থগিতের দাবিতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে মানববন্ধন

বাবুগঞ্জ প্রতিনিধি।। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার জনপ্রিয়, জনবান্ধব ও মানবিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারুক আহমেদের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *