বরগুনা প্রতিনিধি
বরগুনা জেলার উপকূলীয় জনপদে মাছ ধরাই হাজারো মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। গভীর সমুদ্র ও নদী নির্ভর এই জীবিকা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকলেও বাস্তবতায় তা আজ বহু জেলে পরিবারের জন্য ঋণের এক নিষ্ঠুর বন্দিত্বে পরিণত হয়েছে। সরকারি অবহেলা, মহাজনী ঋণের দৌরাত্ম্য, মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ, ন্যায্যমূল্যের অভাব এবং জলবায়ুজনিত দুর্যোগ- সব মিলিয়ে জেলেদের জীবন ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বরগুনা জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। এর মধ্যে উপকূলীয় উপজেলা তালতলী, পাথরঘাটা ও আমতলীতে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি জেলে সরাসরি বঙ্গোপসাগর ও নদীনির্ভর মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে পাথরঘাটা অঞ্চল বরগুনার জেলে অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত, যেখানে বিষখালী নদীর মোহনা মাছ ধরার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে স্থানীয়দের দাবি, প্রকৃত জেলের সংখ্যা সরকারি তালিকার চেয়ে অনেক বেশি হলেও বহু জেলে এখনো নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছেন।
বরগুনার উপকূলীয় উপজেলা তালতলীর জয়ালভাঙা গ্রামের জেলে আবদুল মজিদ সেই বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মাছ ধরেই তার পরিবারের জীবন চলে আসছে। কয়েক বছর আগে মাছ ধরার সক্ষমতা বাড়াতে একটি নৌকা ও জাল কেনার জন্য তিনি স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। মৌখিক চুক্তিতে নেওয়া এই ঋণের সুদের হার মাসে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। লিখিত চুক্তি বা আইনি সুরক্ষা না থাকায় ঋণের বোঝা কমার বদলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেড়েছে।
ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙন বরগুনার উপকূলের নিত্যসঙ্গী। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বরগুনা উপকূল একাধিক বড় ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার জেলে পরিবার। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মাছের প্রাপ্যতা কমে আসছে। করোনাকালীন দীর্ঘ সময় মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা এবং পরবর্তীতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি জেলেদের ব্যয় বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, একটি ছোট মাছ ধরার নৌকা পরিচালনায় আগে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা খরচ হতো, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। কিন্তু মাছের বাজারমূল্য সেই অনুপাতে বাড়েনি। ফলে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বড় ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে, যা জেলেদের ঋণনির্ভরতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিকাংশ জেলে মহাজন বা আড়তদারের কাছ থেকেই ঋণ নিতে বাধ্য হন। কারণ সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে প্রয়োজন হয় জামানত ও জটিল কাগজপত্র, যা দরিদ্র জেলেদের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। ফলে মহাজন বা আড়তদারই একদিকে ঋণদাতা, অন্যদিকে মাছের প্রধান ক্রেতা হয়ে ওঠেন। এই দ্বৈত ভূমিকার কারণে জেলেরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন এবং ঋণের চক্র থেকে বের হতে পারেন না।
সরকারি নিষেধাজ্ঞাও জেলেদের জীবনে বড় চাপ তৈরি করছে। সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এ সময় জেলেরা কার্যত বেকার হয়ে পড়েন। যদিও সরকারি প্রণোদনা হিসেবে চাল ও সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা সময়মতো বা পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরলে জেল ও জরিমানার ঘটনাও ঘটছে, যা জেলেদের সংকট আরও বাড়িয়ে তুলছে।
সরকারি সহায়তার ক্ষেত্রেও রয়েছে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ। জেলে কার্ড, চাল বিতরণ ও বিভিন্ন প্রণোদনা কর্মসূচি থাকলেও প্রকৃত জেলে তালিকা হালনাগাদ না হওয়ায় অনেক প্রকৃত জেলে এসব সুবিধা পাচ্ছেন না। আবার তালিকাভুক্ত কিছু ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত নন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে যাঁরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে, তাঁরাই থেকে যাচ্ছেন সহায়তার বাইরে।
ঋণের ভারে নুয়ে পড়া জেলে পরিবারগুলোর স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থাও চরম সংকটে পড়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় এলাকার জেলে পরিবারগুলোর বড় একটি অংশ নিয়মিত চিকিৎসাসেবা নিতে পারে না। দারিদ্র্যের কারণে শিশুদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি কমে যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে অল্প বয়সেই তারা মাছ ধরার কাজে যুক্ত হচ্ছে। এতে দারিদ্র্যের একটি স্থায়ী চক্র তৈরি হচ্ছে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলমান।
তবে প্রতিকূলতার মধ্যেও ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রয়েছে। বরগুনার পাথরঘাটা অঞ্চলে নারী জেলে লাইলী বেগমের মতো কিছু মানুষ সাহস ও সংগ্রামের মাধ্যমে এই কঠিন পেশায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। এসব উদাহরণ দেখায়, সুযোগ ও সহায়তা পেলে জেলেরাও ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট থেকে উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে প্রকৃত জেলে তালিকা হালনাগাদ, স্বল্পসুদের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ব্যবস্থা চালু, ন্যায্যমূল্যে মাছ বিক্রির নিশ্চয়তা এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
বরগুনার উপকূলজুড়ে আজ হাজারো জেলে পরিবার ঋণের দাসত্বে বন্দি জীবন যাপন করছে। সরকারি নীতি ও মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার এই ব্যবধান দীর্ঘদিন ধরেই অব্যাহত রয়েছে। আবদুল মজিদের মতো অসংখ্য জেলে এখনো আশায় আছেন- একদিন হয়তো তারা ঋণমুক্ত হয়ে নিজের শ্রমের ন্যায্য ফল ভোগ করতে পারবেন। কিন্তু কার্যকর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও সুশাসন ছাড়া সেই আশার আলো ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে।
Daily Bangladesh Bani বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দৈনিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের প্রচার করি।