আহমেদ বেলাল।।
ছেলেমেয়েদের জেলখানায় ঢোকানোর সময় নাম ডাকতে ডাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব। একসময়ে বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘উহ্, এত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়!’ জেলখানা তো এমনিতেই ভর্তি হয়ে আছে। ও কথা শুনে একজন বললেন, ‘এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব।’ জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের গল্প।
বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতে জহির রায়হান এক অবিস্মরণীয় নাম। জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট, আজকের এই দিনে ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, অনুবাদক এবং চলচ্চিত্রকার ছিলেন। মাত্র ৩৭ বছরের জীবনে তাঁর কর্মযজ্ঞ বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করা জহির রায়হান বাংলা সাহিত্য তো বটেই চলচ্চিত্রেও সমানভাবে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। মাত্র ৩৭ বছরের জীবন পরিধি দিয়েই হয়ে উঠেছেন কালজয়ী। এত অল্প সময়ে এত বিপুল খ্যাতি অর্জনের কৃতিত্ব খুব কম মানুষেরই আছে।
১৯৫৭ সালে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ সিনেমায় সহকারী হিসেবে কাজ করার মধ্য সিনেমা নির্মাণের কাজে যুক্ত হন তিনি। পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘কখনো আসেনি’ সিনেমার মাধ্যমে। পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’–এর (উর্দু) পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। ‘বেহুলা’, ‘সুতপার ঈশ্বর’ জহির রায়হান নির্মিত চলচ্চিত্র। বাঙালির ওপর পাকিস্তানিদের নির্মম অত্যাচারের প্রমাণ তুলে ধরেতে তিনি নির্মাণ করেছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ তথ্যচিত্র।
সাহিত্যকর্ম: জহির রায়হানের সাহিত্যযাত্রা শুরু হয় ছোটগল্প দিয়ে। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যের সন্ধানে (১৯৫৫) প্রকাশের পরপরই সাহিত্য অঙ্গনে তিনি স্বীকৃতি পান। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে তিনি প্রকাশ করেন উপন্যাস বরফ গলা নদী (১৯৬০), হাজার বছর ধরে (১৯৬৪), আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯), শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৭০) প্রভৃতি।
হাজার বছর ধরে উপন্যাসে তিনি গ্রামীণ সমাজের জীবনযাপন, প্রেম-বিরহ এবং সামাজিক দ্বন্দ্ব চিত্রিত করেন, যা পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের এক মাইলফলক হয়ে ওঠে। এ বইয়ের জন্য তিনি আদমজী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন (১৯৬৪)।
আরেক ফাল্গুন উপন্যাসে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শহুরে তরুণ সমাজের সংগ্রাম ও প্রেমের দ্বন্দ্ব ফুটে ওঠে, যা ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেও বিবেচিত।
তাঁর ছোটগল্পে উঠে এসেছে সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, ভালোবাসা ও হতাশার টানাপোড়েন। গল্পকার হিসেবে তিনি জীবনঘনিষ্ঠ বর্ণনা ও মানবিক আবেগের প্রকাশে সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
সাংবাদিকতা ও অনুবাদ: চলচ্চিত্রে প্রবেশের আগে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন মর্নিং নিউজ, মিল্লাত ও ইত্তেফাক পত্রিকায়। এ সময় তাঁর লেখায় রাজনৈতিক সচেতনতা, সমাজ পরিবর্তনের তাগিদ এবং নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত হয়।
একইসঙ্গে তিনি বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদক হিসেবেও পরিচিত। দস্তয়েভস্কি, চেখভ, গর্কি, হেমিংওয়ে, গ্রাহাম গ্রিন প্রমুখের সাহিত্যকর্ম তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন। এর ফলে বাংলা পাঠক সমাজ বৈশ্বিক সাহিত্যধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়।
চলচ্চিত্রকর্ম: বাংলা চলচ্চিত্রে আধুনিক ধারার সূচনা জহির রায়হানের হাত ধরে।
তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র কখনো আসেনি (১৯৬১) নতুন ভাষা ও ভঙ্গির সূচনা করে।
কাচের দেয়াল (১৯৬৪) শহুরে জীবনের বিচ্ছিন্নতা ফুটিয়ে তোলে এবং সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে।
বেহুলা (১৯৬৬) বাংলা পুরাণকে আধুনিক চলচ্চিত্রভাষায় রূপ দিয়েছিল।
জীবন থেকে নেওয়া (১৯৭০) ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, যেখানে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণমানুষের প্রতিরোধ শিল্পিতভাবে ফুটে ওঠে। সমালোচকরা একে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাভাস হিসেবে চিহ্নিত করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১) বিশ্বদরবারে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার প্রমাণ তুলে ধরে। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে এ চিত্র প্রদর্শিত হয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে সমর্থন জাগায়।

রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ: জহির রায়হান ছিলেন একজন রাজনৈতিকভাবে সচেতন শিল্পী। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তিনি বাঙালি জাতির অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর চলচ্চিত্র ও সাহিত্যকর্ম শুধু শিল্পসৃষ্টি নয়, বরং রাজনৈতিক সংগ্রামের দলিল।
মৃত্যু: ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি নিখোঁজ হন।মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশই (মুজিব বাহিনী) জহির রায়হানকে খুন করে তার লাশ গুম করে ফেলেন।
তথ্যসূত্র: নির্মল সেন (আমার জবানবন্দি, পৃ ৪০৬)
তিনি মুজিব বাহিনী কতৃক খুন হওয়ায় বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি সংগঠিত হয়েছিল যা কোনদিন পূরণ হওয়ার নয়।
তবে তাঁর সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্রকর্ম আজও বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম, সত্যনিষ্ঠা ও মানবিক চেতনার সাক্ষ্য বহন করে।
জহির রায়হান ছিলেন শিল্প ও রাজনীতির সৃজনশীল সমন্বয়কারী। তাঁর সাহিত্য যেমন মানুষ ও সমাজের বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছে, তেমনি তাঁর চলচ্চিত্র জাতির মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গীত হয়ে উঠেছে। জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করা মানে বাঙালির ইতিহাস, মুক্তি ও মানবিকতার প্রতি দায়বদ্ধতাকে পুনরায় স্মরণ করা। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন—শিল্প মানেই সংগ্রাম, আর সত্যনিষ্ঠ সৃজনশীলতা জাতির অগ্রযাত্রার চালিকাশক্তি।
তথ্যসূত্রঃ ১. জহির রায়হান। হাজার বছর ধরে। ঢাকা: আদমজী পুরস্কার প্রাপ্ত, ১৯৬৪।
২.জহির রায়হান। আরেক ফাল্গুন। ঢাকা: প্রগতি প্রকাশনী, ১৯৬৯।
৩. মজুমদার, অজয়। জহির রায়হান: জীবন ও সাহিত্য। ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৫।
৪.আনিসুজ্জামান খান। “জহির রায়হান ও মুক্তিযুদ্ধ।” বাংলা একাডেমি জার্নাল, ১৯৮২।
৫. Rahman, Syed Anwarul Kabir. Zahir Raihan: The Man and His Works. Dhaka: Bangla Academy, 2001.
৬. বাংলাপিডিয়া
৭. উইকিপিডিয়া
Daily Bangladesh Bani বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দৈনিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের প্রচার করি।