বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪
elish-fishar man

কাউখালীতে মৃত ব্যক্তি ও প্রবাসীদের নামে কার্ড ! জেলেরা অসহায়

আযাদ আলাউদ্দীন ।।

বংশ পরম্পরায় জেলে, মাছ শিকার ছাড়া যাদের সংসার চলেনা, সেই প্রকৃত জেলেরাই সরকারি তালিকায় নিবন্ধিত হতে পারেননি। নিবন্ধন না থাকায় কোনো খাদ্য সহায়তাও তারা পান না। পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলায় নিবন্ধিত জেলেদের তালিকা দেখে হতবাক এলাকাবাসী।

ওই উপজেলার নিবন্ধিত জেলেদের তালিকায় রয়েছেন- শতাধিক মৃত ব্যক্তি ও প্রবাসীর নাম। এছাড়া কখনো মাছ শিকার করেননি কিংবা যাননি নদীপাড়ে। প্রধান পেশা ব্যবসা-বাণিজ্য বা কৃষি। কিন্তু তারাই হয়েছেন নিবন্ধিত জেলে, আছে জেলে কার্ড। কার্ডের কারণে প্রতি বছর জেলে হিসেবে পান খাদ্য সহায়তা। চাল বিতরণের দিন লাইনেও দাঁড়াতে হয় না। অন্য লোকের মাধ্যমে চাল চলে যায় বাড়িতে। খাদ্য সহায়তার নাম তালিকায় সবার আগে থাকে তাদের নাম। আর মৃত ব্যক্তি ও প্রবাসীদের বরাদ্দকৃত খাদ্য সহায়তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিগত সরকারের কিছু প্রভাবশালী লোকজন আত্মসাৎ করেছে। মৃত ব্যক্তির পরিবার ও প্রবাসীরা তারা জানেনও না যে তাদের নামে জেলে কার্ড রয়েছে।

অথচ বংশ পরম্পরায় জেলে, মাছ শিকার ছাড়া যাদের বাঁচার কোনো উপায় নেই, সেই প্রকৃত জেলেরাই সরকারি তালিকায় নিবন্ধিত হতে পারেননি। নিবন্ধন না থাকায় কোনো খাদ্য সহায়তাও তারা পান না। পেটের দায়ে মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময়ে নদীতে নেমে আটক কিংবা নির্যাতনের শিকার হন। হারিয়ে ফেলেন জাল ও নৌকা। গত ১২ বছর ধরে এমনটাই চলছে। উপকূলীয় জেলা পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলা ঘুরে স্থানীয় জেলেদের সাথে কথা বললে তারা জানায় এমন তথ্য।

কয়েকজন জেলে জানান, বিগত সরকারের সমর্থিত ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক ও স্বচ্ছল ব্যক্তিরা জেলে কার্ডধারী। মৃত কিংবা পেশা পরিবর্তনকারীরাও জেলে। কিন্তু প্রকৃত ও নতুন জেলেরা তালিকায় নেই। জেলেদের তথ্য মতে তালিকায় ভুয়া জেলে রয়েছে শতাধিক, আবার বহু প্রকৃত জেলেও বাদ পড়েছেন।

কাউখালী মৎস্য অফিস দাবি করেছেন, ২০১২ সালের তালিকা তৈরির পর ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর হালনাগাদ করে কিছু ভুয়া ও অন্যপেশার লোককে জেলে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে নতুন জেলে যুক্ত করা হয়। কাউখালী উপজেলায় সর্বমোট ২২৭৫ জন নিবন্ধিত জেলেদের কার্ড রয়েছে। এরমধ্যে ১ নং সয়না রঘুনাথপুর ইউনিয়নে ৫১১ জন, ২ নং আমরাজড়ী ইউনিয়নে ৪২৮জন, ৩ নং সদর ইউনিয়নে ২১১জন, ৪ নং চিড়াপাড়া পারসাতুরিয়া ৬৪৫ জন ও ৫ নং শিয়ালকাটি ইউনিয়নে ৪৮০ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন।

জেলেদের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে, চিড়াপাড়া-পারসাতুরিয়া ইউনিয়নের কেশরতা বিজয়নগর ৯ নং ওয়ার্ডের ৮৫ জন নিবন্ধিত জেলেদের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়- এই তালিকায় পাঁচজন মৃত ব্যক্তির নাম রয়েছে- তারা হলেন মোহাম্মদ জাকির হোসেন ক্রমিক নং ১৩০, আবদুল আউয়াল হাওলাদার ক্রমিক নং ১৩৭, আলমগীর হোসেন হাওলাদার ক্রমিক নং ১৪১, মোহাম্মদ আবুল কালাম ক্রমিক নং ৩৫৯, মোহাম্মদ খালেক মোল্লা ক্রমিক নং ৩৯২।

মৃত আবদুল আউয়াল হাওলাদার এর ছেলে মিজান হাওলাদার জানান, তার বাবার নামে যে জেলে কার্ড রয়েছে তা তিনি জানতেন না। কিন্তু তার নামে বরাদ্দকৃত খাদ্য সহায়তা এতদিন আত্মসাৎ করে আসছে। এছাড়া যারা বিদেশে রয়েছেন এরকম রয়েছেন সাতজন রনজিত মৃধা ক্রমিক নং ১৪২ বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন, মোহাম্মদ মনির হাওলাদার ৩৬৫ বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। এ ছাড়া একই ব্যক্তির একাধিক স্থানে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে বরাদ্দকৃত সরকারি সহায়তা দীর্ঘদিন ধরে আত্মসাৎ করে আসছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ।

মোহাম্মদ চুন্নু জোমাদ্দার যার এক জায়গায় ক্রমিক নং ৩৫৭ অন্য জায়গায় ক্রমিক নং ৪১২, মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন এক স্থানে কমিক নং ৩৫৮ অন্যস্থানে ক্রমিক নং ৩৯৭। বিজয়নগর গ্রামের জেলে খলিলুর রহমান যার সিরিয়াল নম্বর ৪০৩ তিনি জানান, কেশরতা বিজয়নগর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ আজিজুল হক ও বিগত সরকারের মৎস্যজীবী নেতারা এসব ভূয়া নিবন্ধিত জেলেদের নামের বরাদ্দকৃত খাদ্য সহায়তা ভুয়া মাস্টাররোল দেখিয়ে আত্মসাৎ করে আসছেন।

তিনি আরো জানান তার নামে বরাদ্দকৃত জেলে কার্ড ইউপি সদস্যের কাছে চাইতে গেলে তাকে গালাগালি করে বলেন তোদের নামে কোন জেলে কার্ড নাই। কিন্তু আমি তালিকা দেখে জানতে পারি আমার নামে আগে থেকেই খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ হয়ে আসছে।অভিযুক্ত ইউপি সদস্য মোঃ আজিজুল হক জানান, একই পরিবারের পাঁচজনের নামে জেলে কার্ড থাকায় এবং অন্য পেশায় থাকায় সবাইকে চাল দেয়া সম্ভব হয় না।

তবে মৃত ব্যক্তির নামে চাল তুলে আত্মসাৎ করার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় প্রত্যেক জেলে ৬০ দিনের জন্য ৫৬ কেজি এবং ৩০ দিনের জন্য ৪০ কেজি চাল পেয়ে থাকেন।চিরাপাড়া-পারসাতুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান লাইকুজ্জামান মিন্টু জানান, মৎস্যজীবীদের এই তালিকা প্রায় ১২ বছর আগের করা তাই অনেকে আছে যাদের জেলে কার্ড রয়েছে কিন্তু তারা স্থানে থাকে না, যখন চাল দেয়া হয় তখন তাদের পরিবারের লোকজন জেলে কার্ড নিয়ে আসলে আমরা কার্ড দেখে খাদ্য সহায়তা প্রদান করে থাকি। বর্তমানে তালিকা হালনাগাদ এর কাজ চলছে।

কাউখালী উপজেলার জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দলের সাধারণ সম্পাদক জিয়া জানান, বিগত যাছাই-বাছাইয়ের সময় সঠিকভাবে যাছাই-বাছাই করা হয় না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিগত সরকারের লোকজন তারা প্রভাব খাটিয়ে হালনাগাদের সময় তালিকায় থাকা ভুয়া জেলে, মৃত জেলে, প্রবাসী, পেশা ছেড়ে দেয়া লোকদের নামে থাকা জেলে কার্ড পরিবর্তিত করে না। এরাই নিয়মিত জেলেদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি সহায়তা পায়। আর তা তারা মিলেমিশে আত্মসাৎ করে। মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল পায় না বহু প্রকৃত জেলে।

মোঃ নান্না মোল্লা নামের একজন জেলে জানান, ভুয়া জেলেদের কারণে খাদ্য সহায়তা বিতরণের সময় ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন জনপ্রতিনিধিরা। তারা টাকা ছাড়া তালিকায় নাম উঠান না, তাই প্রকৃত জেলেরা বাদ পরে যান, সেই সুযোগে ভুয়া জেলেরা তালিকাভুক্ত হয়ে যান।

কাউখালী উপজেলার পুরস্কারপ্রাপ্ত মাছের ঘেরের স্বত্বাধিকারী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক জাহিদুর রহমান ফিরোজ জানান, জেলে কার্ডের মাধ্যমে সরকারি সহায়তা প্রাপ্তদের মধ্যেও শতশত কার্ডধারী রয়েছেন যারা জেলে নয়। তিনি জানান, প্রতি বছর সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তালিকা আপডেট করলে ভুয়া জেলে কমে যাবে এবং প্রকৃত জেলেরা তালিকা ভুক্ত হবে।

কাউখালী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান জানান, তালিকাটি অনেক আগের থাকায় প্রকৃত জেলে বাছাই করতে গেলে প্রতিটি স্থানে কিছু সমস্যা রয়েছে। বর্তমানে জেলে তালিকা একটি চলমান প্রক্রিয়া প্রতিটি ইউনিয়নে হালনাগাদের কাজ চলছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার সজল মোল্লা জানান, মৃত ব্যক্তি ও অন্যান্য পেশায় জেলে কার্ড থাকার অভিযোগ পেয়েছি। এ কারণে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে সরজমিনে গিয়ে তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করেছি।মৎস্য অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, প্রকৃত জেলে শনাক্ত করে নিবন্ধনকরণ এবং তাঁদের পরিচয়পত্র প্রদান ও ব্যবস্থাপনার জন্য ২০১২ সালের মার্চ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত একটি প্রকল্প শুরু করে সরকার। এর মাধ্যমে একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি করে জেলেদের ডিজিটাল পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। এ পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ জেলে হলেও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পান না। তবে জেলে পরিচয়পত্র নীতিমালা তৈরি হয় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে।

ওই নীতিমালার আলোকে প্রতি বছর জুলাই হতে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রতিটি উপজেলা মৎস্য অফিস তালিকা হালনাগাদ করবে, মৃত জেলেদের নাম্বার বাদ দিয়ে নতুনদের নাম যুক্ত করার কথা রয়েছে নীতিমালায়। এজন্য উপজেলা পর্যায়ে ১২ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটিও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না বলে স্থানীয়ভাবে জানা গেছে।

আরো পড়ুন

dr. shofiqur rahman

যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফিরেছেন জামায়াত আমির

বাংলাদেশ বাণী ডেস্ক॥ আজ বৃহস্পতিবার সকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে জামায়াত আমিরকে ফুলের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *